top ad image
top ad image
home iconarrow iconমতামত

দিল্লিতে বাংলাদেশবিরোধী বিক্ষোভ ঘিরে যা ঘটল

দিল্লিতে বাংলাদেশবিরোধী বিক্ষোভ ঘিরে যা ঘটল
চাণক্যপুরীতে মূল সভামঞ্চ থেকে বক্তাদের ভাষণ

দিল্লির তিনমূর্তি চক শহরের খুব ব্যস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ একটা এলাকা। ওই গোলচক্করের এক দিকে প্রধানমন্ত্রী সংগ্রহশালা, উল্টোদিকে এমপি-দের বাসস্থান সাউথ অ্যাভিনিউ। দিল্লির সবচেয়ে অভিজাত ল্যুটিয়েন্স জোনের আরও দু'তিনটে রাস্তা এসে মিশেছে ওই বৃত্তে, কাজেই জায়গাটা সব সময় ভিভিআইপি-দের চলাচলে ত্রস্ত! তার ওপর পার্লামেন্টের অধিবেশন চললে তো কথাই নেই, যেমন এখন চলছে।

তা সত্ত্বেও মঙ্গলবার কাজের দিনেও সকাল দশটা থেকেই দিল্লি পুলিশ যখন সেই চকে ব্যারিকেড বসিয়ে যান চলাচল আটকে দিল, তখন বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে এখানে যেটা এখন হতে যাচ্ছে সেটাও মোটেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

আসলে ভারতের শাসক দল বিজেপির আদর্শিক অভিভাবক আরএসএসের প্রচ্ছন্ন সমর্থনে যখন রাজপথে একটা কর্মসূচি নেওয়া হয়, দিল্লি পুলিশের তাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করা ছাড়া সম্ভবত কোনও রাস্তা থাকে না। আর আজকেও ঠিক সেটাই ঘটল।

উপলক্ষটা ছিল বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের বিরুদ্ধে দিল্লিতে সে দেশের হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি। যার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল আজ বিশ্ব মানবাধিকার দিবসকে (১০ ডিসেম্বর)।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য পুলিশ বিক্ষোভকারীদের বাংলাদেশ দূতাবাসের ধারেকাছেও ঘেঁষতে দেয়নি মূলত নিরাপত্তার কারণে, তবে চাণক্যপুরীর দূতাবাস পাড়ায় এই বিক্ষোভ যে রীতিমতো জবরদস্ত ছিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

ধারালো বক্তৃতায়, মুহুর্মুহু স্লোগানে আর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে হুঙ্কারে বারেবারেই কেঁপে উঠছিল চাণক্যপুরী। আরএসএসের সহযোগী সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) বা দুর্গাবাহিনীর স্বেচ্ছাসেবীরা সকাল থেকেই ভিড় নিয়ন্ত্রণের কাজে লেগে পড়েছিলেন। শহরের নানা প্রান্ত থেকে বাস বোঝাই করে আনা হয়েছিল শত শত সমর্থককে।

মিডিয়ার প্রতিনিধিদের স্বাগত জানানো হচ্ছিল হাসিমুখে। কোথায় তারা গাড়ি পার্ক করবেন, কোথায় পানীয় জলের ব্যবস্থা সব দেখিয়ে দিচ্ছিলেন কর্মীরা। সোজা কথায়, একটা অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ও সুবিন্যস্ত সমাবেশের আয়োজন ছিল এই কর্মসূচিকে ঘিরে, পুলিশ ও প্রশাসনও যার দিকে সব ধরনের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল।

কারা সভায় ছিলেন, কী বললেন

দিনকয়েক আগে যখন দিল্লিতে সাংবাদিক সম্মেলন করে এই কর্মসূচির কথা ঘোষণা করা হয়, তখন আরএসএসের অন্যতম মিডিয়া কোঅর্ডিনেটর রজনীশ জিন্দাল সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তবে তখনই স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল, আরএসএস নয় – এই বিক্ষোভ কর্মসূচি হবে 'সিভিল সোসাইটি অব দিল্লি' নামে সুশীল সমাজের একটি সংগঠনের ব্যানারে।

ঢাকায় ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত ভিনা সিক্রি কিংবা ভারতের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর সাবেক প্রধান রাজীব জৈনও ছিলেন সেই সাংবাদিক সম্মেলনে। জানানো হয়েছিল, প্রায় শ'দুয়েক বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সাবেক আমলা ও কর্মকর্তা এই সংগঠনের সদস্য।

আজকের সভায় সেই সদস্যরা তো ছিলেনই – তবে লোক জড়ো করার মূল কাজটা করেছিল ভিএইচপি। পরিষদের নেতা বিনোদ বনশল শুরু থেকেই দৌড়ঝাঁপ করে যাচ্ছিলেন। মঞ্চের সামনে প্রথম তিন-চারটে সারি বরাদ্দ ছিল হিন্দু সাধু-সন্তদের জন্য। এসেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের একঝাঁক আইনজীবীও।

শুধুমাত্র নারী সদস্যদের নিয়ে তৈরি ভিএইচপি-র শাখা দুর্গাবাহিনীর প্রধান সাধ্বী ঋতাম্ভরা আগাগোড়া বসে ছিলেন মঞ্চে। অন্যরা মাত্র তিন মিনিট বলার সুযোগ পেলেও তার জন্য কোনও সময় বেঁধে দেওয়া হয়নি – তিনিও বেশ অনেকক্ষণ ধরে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে গেলেন, ভাষণ শুরুই করলেন 'ভারতমাতা কি জয়' আর 'অখন্ড ভারতে'র নামে জয়ধ্বনি দিয়ে।

ঋতাম্ভরা জানালেন, ‘যেকোনও যুদ্ধে নারীরা সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত হয়, বাংলাদেশে হিন্দু নারীদের ক্ষেত্রেও এখন তাই হচ্ছে। তাদের গণধর্ষণ করা হচ্ছে, হত্যা করা হচ্ছে।’

ভারতের হিন্দুরা বেশি দিন যে এটা সহ্য করবে না এবং 'বসে বসে দেখবে না' – এই হুঙ্কারও দিলেন তিনি। তার আগে বলতে উঠে সাবেক কূটনীতিবিদ ভিনা সিক্রি বললেন, ‘গতকাল আমাদের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিস্রি বাংলাদেশে গিয়েছিলেন।’

‘তিনি এই বার্তাই তাদের দিয়ে এসেছেন যে সম্পর্ক আমরা এগিয়ে নিতে চাই, মানুষে-মানুষে সংযোগ বাড়াতে চাই, যে প্রকল্পগুলোর কাজ শুরু হয়ে গেছে সেগুলোও শেষ করতে চাই। কিন্তু এগুলো তখনই হবে যখন সে দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন বন্ধ হবে। তা না হলে আমাদের পক্ষে এগোনো সম্ভব নয়’, জানালেন তিনি।

ইস্কন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারির বিরুদ্ধেও সরব হতে দেখা গেল প্রায় সব বক্তাকেই। কলকাতা হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি ও অধুনা বিজেপি এমপি অভিজিৎ গাঙ্গুলি পরিষ্কার বাংলায় বললেন, "হিন্দু আজকে জোট বেঁধেছে, একত্রিত হয়েছে – যে কারণে তোমরা একজন সন্ন্যাসীকে জেলে পুরেছ। একজন সন্ন্যাসীকে জেলে পোরার ধৃষ্টতা তোমরা দেখিয়েছে, এর শাস্তি তোমাদের পেতেই হবে।’

অভিনেতা তথা পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা রুদ্রনীল ঘোষও প্রায় একই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করলেন।

হিন্দিতে বিক্ষোভ মিছিলের নামকরণ করা হয়েছিল ‘আক্রোশ মার্চ’

‘একাত্তর মনে করো, জুলুমবাজি বন্ধ করো’

এদিনের সমাবেশে একটা বিষয় চোখ এড়ায়নি – বাংলাদেশকে বার বার মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, একাত্তরে ভারত যেভাবে তাদের সাহায্য করেছে তার জন্য তাদের অবশ্যই কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। বিভিন্ন প্ল্যাকার্ডে ও স্লোগান বারবার উঠে এসেছে এই বক্তব্য, ‘বাংলাদেশ, একাত্তর মনে করো, জুলুমবাজি বন্ধ করো!’

মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের কথা স্মরণ করে আজকের বাংলাদেশেও হিন্দু নির্যাতন বন্ধ করা উচিত, সমাবেশে এই কথাটাই ঘুরেফিরে এসেছে। দিল্লি ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে এদিনের সমাবেশে যোগ দিতে এসেছিলেন বিজেপির কট্টর সমর্থক দেবরাজ আহুজা।

মি আহুজা বিবিসিকে বলছিলেন, ‘আমি তো বলব বাংলাদেশে আমরা দুধকলা দিয়ে সাপ পুষেছি। একাত্তরে আমরা ওদের দেশ বানিয়ে দিয়েছি, আর এখন সেই বিষাক্ত সাপই আমাদের কাটতে আসছে। লজ্জা হওয়া উচিত।’

‘আর একটা জিনিস হল মুহাম্মদ ইউনূস তো নোবেল পেয়েছেন। কীসে? না, শান্তিতে। তা এখানে উনি কোন শান্তির কাজটা করছেন?’ বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধেও স্লোগান শোনা গেছে এদিন, ‘হিন্দুয়োঁ কি কাতিল, ইউনূস তুম নিপাত যাও!’

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো মানবাধিকার সংগঠন কিংবা জাতিসংঘের মানবাধিকার বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে নীরব কেন, সভায় এই প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে। এই বার্তা নিয়ে দেখা গেছে অজস্র প্ল্যাকার্ডও। বিক্ষোভ কর্মসূচি দিল্লিতে হলেও অনেক প্ল্যাকার্ড ছিল বাংলাতেও। যার একটায় লেখা ছিল, ‘বাংলা বাঁচাও, বাঙালি বাঁচাও, বাঁচাও সনাতন!’

দূতাবাসে গিয়ে স্মারকলিপি পেশ

রাধাকৃষ্ণন মার্গের বাংলাদেশ দূতাবাস অভিমুখে মিছিল কিছুটা এগোতেই শান্তিপথের মুখেই পুলিশ অবশ্য বিক্ষোভকারীদের আটকে দেয়। হাই কমিশন সেখান থেকে তখনও প্রায় দু'আড়াই কিলোমিটার দূরে। তখন আয়োজকদের পক্ষ থেকে দু'জন প্রতিনিধি গিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের হাতে সে দেশে হিন্দু নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি স্মারকলিপি তুলে দেন।

দিল্লি পুলিশের একটি সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছে, চাণক্যপুরীর স্পর্শকাতর কূটনৈতিক এলাকা দিয়ে কয়েক হাজার মানুষের মিছিল যাওয়ার অনুমতি দেওয়া সম্ভব নয় বলেই তারা অনেক আগে সেটিকে আটকে দিয়েছেন।

বস্তুত ওই পথেই পড়ে যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, চীন, যুক্তরাজ্য-সহ বিভিন্ন দেশের দূতাবাস, যেগুলো নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় মোড়া থাকে সব সময়। ‘তা ছাড়া কিছুদিন আগে আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাই কমিশনে যা ঘটে গেছে, তারপর আমাদের পক্ষে কোনও ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব নয়’, বলছিলেন দিল্লি পুলিশের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা।

তবে বাংলাদেশ বা সে দেশের সরকারের বিরুদ্ধে কোনও বিক্ষোভ দিল্লিতে আজ বহু বহু বছরের মধ্যে এই প্রথম ঘটল। গত শতাব্দীর আশি বা নব্বইয়ের দশকেও বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠন দিল্লিতে নিয়মিতই বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাত। কিন্তু শেখ হাসিনার আমলে তা একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়।

‘শেখ হাসিনার আমলেও যে সে দেশে হিন্দু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি তা নয়, কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আমরা ভিএইচপি বা আরএসএসকে কিন্তু তখন পথে নামতে দেখিনি’, বলছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুকল্যাণ গোস্বামী।

চাণক্যপুরীর এই সমাবেশ ছাড়াও দিল্লির 'ধরনা-রাজধানী' যন্তর মন্তরেও আজ বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে আরএসএসের মুসলিম শাখা 'মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চ'।

এছাড়া আজ বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে জম্মু, হায়দ্রাবাদ, লখনৌ-সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে একই ইস্যুতে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে।

r1 ad
r1 ad