ভারতে শেখ হাসিনার কীভাবে রয়েছেন, সামনেই বা কী?\n
ঢাকার পালাবদলে দিল্লির হতাশা
গত ৫ আগস্ট যে নাটকীয় পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ক্ষমতা থেকে বিদায় নেন এবং মাত্র আড়াই দিনের মধ্যে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয় – প্রতিবেশী ভারত সেই পরিস্থিতির জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না, তারা দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করেনি তাদের ঘরের দোরগোড়ায় এত দ্রুত এই ধরনের ঘটনা ঘটে যেতে পারে!
ভারতে একাধিক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক তাদের লেখালেখি ও বক্তৃতায় এ কথাটা খোলাখুলি স্বীকার করেছেন। বস্তুত জুলাইয়ের শেষ দিকে বা অগাস্টের প্রথম দু-চারদিনেও ভারতের নর্থ ও সাউথ ব্লকের একাধিক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে একান্ত আলোচনায় বলেছিলেন, শেখ হাসিনা বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে থাকলেও নিশ্চিতভাবেই এই সংকটও ‘সারভাইভ’ করবেন– এটা নিয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশই নেই!
শেষ পর্যন্ত সেটা যখন হলো না, তখন আক্ষরিক অর্থেই ভারতের মাথায় একরকম আকাশ ভেঙে পড়েছিল। তার আগের দেড় দশক ধরে শেখ হাসিনার জমানায় ভারত বাংলাদেশে যে পরিমাণ অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক ‘লগ্নি’ করেছে, তার ভবিষ্যৎ এখন কী হবে সেটাও দিল্লিকে উদ্বিগ্ন করে তোলে।
বাংলাদেশে ক্ষমতার রাশ ইসলামপন্থীদের হাতে চলে যাচ্ছে কি না, তা নিয়েও খোলাখুলি আশঙ্কার কথা জানান দেশের অনেক নেতা-মন্ত্রী ও নীতি-নির্ধারক। এই উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকেই দিল্লিতে ক্ষমতার অন্দরমহলে বাংলাদেশকে ঘিরে জন্ম নেয় একটা ‘ফ্রাসট্রেশন’ বা হতাশা– যার প্রতিফলন এখন ঢাকার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কেও দেখা যাচ্ছে।
দিল্লির উপকণ্ঠে ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বলছিলেন, “বিগত বহু বছর ধরে ভারতের ঘোষিত অবস্থান ছিল তারা বাংলাদেশে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও প্রগতি ও সমৃদ্ধির পক্ষে– যেটাকে শেখ হাসিনার শাসনের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন বলেই ধরে নেওয়া হতো।”
‘এখন রাতারাতি সেই অবস্থার পরিবর্তনের পর ভারত যেন ধরেই নিচ্ছে বাংলাদেশ একটা অস্থিরতা আর অস্থিতিশীলতার কবলে পড়েছে।’ ‘তার ওপর যখন সে দেশের নতুন সরকার দিল্লির সঙ্গে সম্পর্কটাকে প্রকাশ্যে অন্তত বিশেষ একটা ‘ভ্যালু’ করছে না, তাতে বিরক্তিটা আরও বাড়ছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ড. দত্ত।
কোনও কোনও পর্যবেক্ষক বলছেন, বাস্তবিকই ভারতে একটা শ্রেণির ধারণা ছিল বাংলাদেশকে যে ধরনের অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে তাতে তাদের নতুন সরকার শ্রীলঙ্কার মতোই হয়তো ভারতের সাহায্য চাইতে বাধ্য হবে।
কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেছে, বাংলাদেশ হাত পাতলেও সেটা পেতেছে পশ্চিমা দেশগুলো কিংবা বিশ্ব ব্যাঙ্ক-আইএমএফের কাছে– আর ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা ‘ডিফায়ান্ট’ বা পরোয়া-করি-না ভঙ্গি দেখানোর চেষ্টা করে চলেছে। এতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে অস্বস্তি বেড়েছে নিঃসন্দেহে।
তবে ভারতে সাবেক কূটনীতিবিদদের একটা অংশ আবার প্রবলভাবে বিশ্বাস করেন, এখানে বিষয়টা মোটেই হতাশার কিছু নয়– বরং কূটনৈতিক বাস্তবতার, আর সেটা উপলব্ধি করতে ঢাকার অন্তর্বর্তী সরকারই ব্যর্থ হচ্ছে।
ঢাকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন, এমনই একজন সাবেক সিনিয়র কর্মকর্তা যেমন বিবিসিকে বলছিলেন মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী সরকার পূর্ণ মর্যাদায় ও সমানে-সমানে ডিল করবে ‘এটা আসলে আশা করা উচিতই নয়!’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই প্রাক্তন রাষ্ট্রদূতের কথায়, ‘ড. ইউনূসকে বলব, আপনার সরকারের সাংবিধানিক ভিত্তি কী, সেটাই তো স্পষ্ট নয়! আর আদৌ যদি কোনও বৈধতা থেকে থাকে – সেটা নব্বই দিনের বেশি নয়, আর তাও শুধু নির্বাচন আয়োজনের জন্য!’
‘সেই জায়গায় আমরা কী দেখছি, নব্বই দিন কেটে গেছে আর আপনারা দেশ সংস্কারে নেমেছেন! ইন্টারভিউ দিয়ে বলছেন, তিস্তা সহ অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টন হতে হবে সমতা আর ন্যায্যতার ভিত্তিতে।’
‘আরে বাবা, ভারত আপনাদের সঙ্গে তিস্তা নিয়ে কথা বলতে যাবে কোন দুঃখে?’ ‘বাংলাদেশের মানুষের ভোটে জিতে আপনারা ক্ষমতায় আসেননি, আপনাদের কোনও ম্যান্ডেটও নেই এটা নিয়ে কথা বলার,’ চাঁছাছোলা ভাষায় জানিয়ে দেন তিনি।
ঘটনা হলো, ভারতে যারা ক্ষমতার কেন্দ্রীয় বলয়ে আছেন এবং বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক কী হবে তার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করেন, তাদের অধিকাংশ কিন্তু এই যুক্তিতেই বিশ্বাস করেন।
তবে অন্তর্বর্তী সরকার সে দেশে দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করলে দিল্লির এই মনোভাবের পরিবর্তন হতে পারে, সেই ইঙ্গিতও কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে। যতদিন না সেটা বাস্তবে ঘটছে, দিল্লি ও ঢাকার শীতল কূটনৈতিক সম্পর্কের বরফ গলবে সেই সম্ভাবনা সত্যিই আসলে খুব ক্ষীণ!