top ad image
top ad image
home iconarrow iconছাত্র রাজনীতি

‘দখলদারিত্ব-র‌্যাগিং ঠেকাতে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ কোনো সমাধান নয়’

‘দখলদারিত্ব-র‌্যাগিং ঠেকাতে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ কোনো সমাধান নয়’

দখলদারিত্ব ও র‌্যাগিং ঠেকাতে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ কোনো সমাধান হতে পারে না বলে মনে করে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট।

সম্প্রতি বুয়েটের উদ্ভুত পরিস্থিতিতে আজ শুক্রবার ছাত্র ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সালমান সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক রাফিকুজ্জামান ফরিদ এক যৌথ বিবৃতিতে এ কথা বলেন।

বিবৃতিতে তারা বলেন, আবরার ফাহাদ হত্যার পর তাঁর সহপাঠী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা মিলে সন্ত্রাসী ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, তা নিঃসন্দেহে প্রেরণাদায়ক। গোটা ক্যাম্পাস একত্র হয়ে এ ধরনের আন্দোলনের ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে নজিরবিহীন। তাদের এই সংগ্রামী মনোভাবের কারণে আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচারও সম্পন্ন হয়েছে। ফ্যাসিবাদী নিপীড়নের এই ভয়ঙ্কর সময়ে, বুয়েটের শিক্ষার্থীদের এই উদাহরণ সৃষ্টিকারী লড়াইকে আমরা অভিবাদন জানাই।

এই সময়ে বুয়েটের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যেমন প্রেরণা জুগিয়েছে, তেমনি তাদের ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে ব্যাপক মাত্রায়। একথা ঠিক যে, বর্তমান প্রজন্মের বুয়েট শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতি বলতে ছাত্রলীগের রাজনীতিকেই দেখেছেন, তাদের গেস্টরুম, র‌্যাগিং, তোলাবাজি, ফাও খাওয়া, জুনিয়রদের নির্যাতন— এগুলোই প্রত্যক্ষ করেছেন। তাই আবরার হত্যার পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি এসেছিল ছাত্রলীগের রাজনীতি বন্ধের আকাঙ্ক্ষা থেকেই। সম্প্রতি রাতের আঁধারে সদলবলে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতির মহড়া দেয়াকে কেন্দ্র করে বিষয়টি আবার সামনে আসে।

প্রথমত, এ প্রসঙ্গে শুরুতেই একটা বিষয় স্পষ্ট করা জরুরি। ছাত্ররাজনীতি কিংবা ক্যাম্পাসের গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিয়ে ছাত্রলীগের বক্তব্য রাখার কোনো নৈতিক অধিকার আছে বলে আমরা মনে করি না। যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন কিংবা গত এক দশকের মধ্যে পাশ করে বেরিয়েছেন, তারা জানেন ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগ কী ধরণের পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছে। গেস্টরুম, র‌্যাগিং, তোলাবাজি, ডায়নিংয়ের টাকা চুরি, টেন্ডার নিয়ে মারামারি— কিসে নেই ছাত্রলীগ! বাস্তবে ক্যাম্পাসগুলো এককভাবে তারা দখল করে আছে, সেখানে অন্য কোনো সংগঠনের কাজ করার কোনো পরিবেশ তারা রাখেনি। গোটা দেশের যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়—ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখার পূর্বশর্তই হচ্ছে সেখানে থেকে ছাত্রলীগের দখলদারিত্বের উচ্ছেদ ঘটানো। সেই ছাত্রলীগ যখন ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য লড়াইয়ের হুংকার দেয়, তখন তারা কী গণতন্ত্র চাইছে সেটা বুঝতে কারও সমস্যা হয় না।

একই কারণে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরও এই নৈতিক অধিকার রাখে না। ২০০২ সালের জুন মাসে টেন্ডার ভাগাভাগি নিয়ে তৎকালীন সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে নিহত হন রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাবেকুন নাহার সনি। সেদিনও এর বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এই আন্দোলনকে নির্মমভাবে দমন করেছিল। ছাত্রদলের সে সময়ের ভূমিকা সকলেই জানেন। শুধু বুয়েট নয়, প্রায় সবগুলো ক্যাম্পাসে সরকার বদলের সাথে সাথে হলের মালিকানা বদলে যায়। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন প্রায় সকল ক্যাম্পাসের অঘোষিত প্রশাসনে পরিণত হয়। ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। যদিও আজ তারা ক্ষমতাসীনদের দ্বারা ভীষণভাবে নির্যাতিত।

দ্বিতীয়ত, বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ শক্তি রাজত্ব করছে বলে যে আশঙ্কার কথা বারবার ছাত্রলীগ ব্যক্ত করছে এবং এর মাধ্যমে তাদের কর্মকাণ্ডে দেশের গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন মানুষের সমর্থন আদায় করতে চাইছে—সেটা ছাত্রলীগের দখলদারিত্বের রাজনীতির একটি কৌশল মাত্র। ছাত্রলীগ এই মূহুর্তে দেশের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ও ছাত্রস্বার্থবিরোধী ছাত্র সংগঠন। এই ছাত্রলীগই ২০১০ সালে বুয়েটের আহসানউল্লাহ হলের ক্যান্টিনে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি গৌতম কুমার দে—কে বেধড়ক পিটিয়ে মৃত মনে করে ফেলে রেখে যায়। গৌতমের হাত ও পা ভেঙে গিয়েছিল। ছাত্রফ্রন্টের ‘দোষ’ ছিল তারা ক্যাম্পাস ও তার আশেপাশে ছাত্রলীগের চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কথা বলেছিল। এই ছাত্রলীগ যখন প্রতিক্রিয়াশীল, অন্ধকারের শক্তিকে রুখে দেয়ার কথা বলে— এটাকে রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।
তবে কিছু বিষয় বুয়েটের শিক্ষার্থীদের আমরা ভেবে দেখতে বলব। আন্দোলনের একটা জটিল ও কঠিন মূহুর্তে দখলদারিত্ব রুখতে আপনারা ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি তুলেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে আপনারা ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগের দখলদারিত্বকে সাময়িকভাবে প্রতিরোধ করতে সক্ষমও হয়েছেন। ক্যাম্পাস আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাক, সেটা আপনারা কেউই চান না। আপনাদের এই আকাঙ্ক্ষার সাথে একমত পোষণ করেও আমরা বলতে চাই—

১. ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারের জন্য ক্ষমতাসীন দল ও সংগঠন যে উদ্যোগ নিচ্ছে সেটা ছাত্ররাজনীতি বন্ধ রাখার মাধ্যমে ঠেকানো যাবে না। তথাকথিত রাজনীতিবিহীন ক্যাম্পাসে প্রশাসনের একতরফা কর্তৃত্ব ছাত্র অধিকারকে মারাত্মকভাবে সংকুচিত করে। লুটপাট ও দুর্নীতি অনিয়ন্ত্রিত হয়। দেশের মধ্যে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ আমাদের চোখের সামনেই আছে। রাজনীতিমুক্ত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সংকটমুক্ত হতে পারেনি কখনও। এই সংকট বেড়ে যাওয়ার কারণে রাজনীতি থেকে দূরে থাকা শিক্ষার্থীরা শেষ পর্যন্ত আবাসন, চিকিৎসাসহ ৫ দফা দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন। কয়েকজন শিক্ষকও এই ন্যায্য দাবিকে সমর্থন করেছিলেন। পরিণতিতে দুইজন শিক্ষার্থী ও ৩ জন শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয়। বুয়েটে এখনও আবরারের রক্তের দাগ মুছে যায়নি, তাই ক্যাম্পাসে এই কয়েকবছর আপেক্ষিকভাবে একটি ভাল সময় কাটিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে, ছাত্ররাজনীতিমুক্ত হলেও বুয়েট ক্যাম্পাস লুটপাট, দুর্নীতি, র‌্যাগিংমুক্ত থাকবে না। এগুলো বুয়েট ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরেই জন্ম নেবে। প্রশাসনের বিরুদ্ধে কিছু বলতে চাইলে ছাত্ররাজনীতির দায়ে অভিযুক্ত করে ছাত্রদের শাস্তি দেয়া হবে। কারণ প্রচলিত সংজ্ঞায় দুর্নীতি, র‌্যাগিং, লুটপাট কোনো রাজনীতি নয়— এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, মিছিল— ইত্যাদি হলো রাজনীতি।

২. বুয়েটে দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের একটি অংশ পড়তে আসে। তারা শুধু দেশের নয়, গোটা বিশ্বের তথা মানবসমাজের ভালোমন্দ নিয়ে আলাপ—আলোচনা করবে এটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে তার মত ও চিন্তাকে প্রকাশ ও প্রচারে বাধা দিলে, সেই প্রতিষ্ঠান কি সমাজমুখী, জনমুখী, উচ্চ মূল্যবোধ ও দক্ষতাসম্পন্ন প্রকৌশলী তৈরি করতে পারবে? আবরারকে যে ফেসবুক পোস্টের জন্য পিটিয়ে মেরে ফেলা হলো, সেটা ছিল ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন নিয়ে আবরারের মতামত। তার পোস্টে তিনি ভারতকে মংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া, ফেনী নদী থেকে পানি প্রত্যাহার, এলপিজি আমদানি— ইত্যাদি বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। এই অপরাধে তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হলো। আবরারের মৃত্যুর বিনিময়ে অর্জিত নতুন ক্যাম্পাসে বাকস্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অধিকার কেউ খর্ব করতে পারবে না, এরজন্য কাউকে নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হবে না— এটাই ছিল স্বাভাবিক প্রত্যাশা। বুয়েটের আন্দোলনের বর্তমান যুক্তিধারা এই আকাঙ্ক্ষাকে পুরোপুরি ধারণ করতে পারছে না বলেই আমাদের মনে হচ্ছে। আবরারের ওপর নির্যাতন ও তার শারীরিক মৃত্যু যতটা গুরুত্ব পাচ্ছে, তার চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর আক্রমণটা ততই পিছনে পড়ে যাচ্ছে।

৩, শিক্ষার্থীদের ছাত্রলীগবিরোধি সঠিক অবস্থান, তাদের আন্দোলন, মিছিল, সমাবেশ, দাবি পেশ, সংবাদ সম্মেলন, প্রধানমন্ত্রী বরাবর খোলা চিঠি— এ সবই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিও একটি রাজনৈতিক দাবি। ফলে বুয়েটে রাজনীতি আছেই। এই মুহূর্তে দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে, প্রতিষ্ঠান হিসেবে, বুয়েটের বর্তমান ও প্রাক্তণ শিক্ষার্থীরাই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক আলাপ—আলোচনা করছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিভাবে চলবে— এ নিয়ে বর্তমান ও এলামনাইদের মধ্যে তর্ক—বিতর্ক, অনলাইন পোলিং ইত্যাদির মাধ্যমে একটা সমাধান খুঁজে নেয়ার চেষ্টা এ সময়ে বুয়েট ছাড়া আর কোন ক্যাম্পাসে নেই। এককথায় বুয়েটই বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক ক্যাম্পাস। সেক্ষেত্রে বিভিন্ন মত, চিন্তা, অভিব্যক্তি, সংগঠনের স্থান বুয়েটে হবে না— এরকম দাবি করাটা কি সঠিক হয়?

৪. বুয়েটে ২০১৯ সালের আগে বৃহৎ ছাত্রআন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল ২০০২ সালে, সনি হত্যার প্রতিবাদে। সেসময় প্রশাসন ছাত্ররাজনীতি বন্ধের আদেশ জারি করেছে, কিন্তু রাজনীতি বন্ধ হয়নি। ছাত্রদের আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম ছিল ‘সন্ত্রাসবিরোধী বুয়েট ছাত্র ঐক্য’। সেসময় ছাত্ররা বরং বুয়েট পরিচালনার ক্ষেত্রে অনুসৃত ১৯৬১ সালের অগণতান্ত্রিক অধ্যাদেশ বাতিল চেয়েছে। সেই অধ্যাদেশবলেই মিছিল করার অপরাধে সেসময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার করা হয়েছিল। আন্দোলনের পরে হলে ছাত্রদলের দখলদারিত্ব টেকেনি, এটা আন্দোলনেরই অর্জন ছিল। অপরাজনীতিকে সঠিক রাজনীতির মধ্য দিয়ে মোকাবেলা না করে রাজনীতির উপরই পুরো দায় চাপিয়ে দিলে তাতে অপরাজনীতির লাভই হয়। কারণ কালের পরিক্রমায় ঘটনার তীব্রতা কমলে, বিভিন্ন ষড়যন্ত্রমূলক পথে সে তার রাস্তা ঠিকই করে নেয়। কিন্তু তাকে যে রুখতে পারতো, সেই সঠিক রাজনীতিটাই তখন আর শক্তি নিয়ে উপস্থিত থাকতে পারে না।

আমরা এই বিষয়গুলো বুয়েটের শিক্ষার্থীদের ভেবে দেখার জন্য আহ্বান জানাবো। আপনারা যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন, সেটাকে না বুঝে ও একে মর্যাদা না দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দখলদারিত্ববিরোধি লড়াই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না— এটা আমরা আন্তরিকভাবেই মনে করি।

তারা আরো বলেন, ছাত্র ফ্রন্ট ছাত্ররাজনীতিতে দখলদারিত্ব, জোর-জুলুম, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে গোটা দেশজুড়ে লড়াই—সংগ্রাম পরিচালনা করে আসছে এবং আগামীতেও করবে। ছাত্রসমাজ যাতে জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি উন্নত রুচি-সংস্কৃতি ও মর্যাদাবোধের ভিত্তিতে চরিত্রবান মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে—সেই লক্ষ্যে আমরা আমাদের সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করছি।

r1 ad
r1 ad