top ad image
top ad image
home iconarrow iconবিশ্ব রাজনীতিarrow iconফিচার

ইতিহাস

পুলওয়ামা হামলা : কাশ্মির সেদিন কেঁপে উঠেছিল

পুলওয়ামা হামলা : কাশ্মির সেদিন কেঁপে উঠেছিল
পুলওয়ামা হামলায় নিহত হয় ভারতের ৪০ জন আধাসামরিক সৈন্য

২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। যখন বিশ্বজুড়ে ভালোবাসার বার্তা ছড়াচ্ছিল, ঠিক সেই সময় ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যে ঘটেছিল এক ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা। পুলওয়ামা জেলার লেথপোরায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় প্রাণ হারান ভারতের আধা-সামরিক বাহিনী সিআরপিএফ-এর ৪০ জন সদস্য। এই ঘটনা শুধু ভারত নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়াকেই কাঁপিয়ে দেয়। সেই থেকে এই হামলা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে চিহ্নিত।

সেদিন জম্মু থেকে শ্রীনগর যাওয়ার পথে ৭৮টি গাড়ির একটি সিআরপিএফ কনভয় জম্মু-শ্রীনগর জাতীয় সড়কে অবন্তীপাড়া ও লেথপোড়ার মধ্যবর্তী স্থানে পৌঁছায়। একটি বিস্ফোরক বোঝাই গাড়ি ধাক্কা মারে নিরাপত্তা কর্মীদের বহনকারী একটি বাসে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে বাসটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। মুহূর্তেই প্রাণ হারান ৪০ জন জওয়ান এবং হামলাকারী। পরে জানা যায়, হামলাটি করেছিলেন আদিল আহমদ দার নামের একজন কাশ্মীরি যুবক, যিনি পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মোহাম্মদের সদস্য ছিলেন।

কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত নতুন নয়। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকেই কাশ্মীর অঞ্চলকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে তিনটি যুদ্ধ হয়েছে। তবে ১৯৮৯ সালের পর থেকে কাশ্মীরের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। ভারত-শাসিত কাশ্মীরে একদিকে যেমন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি পাকিস্তানের সহায়তায় ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির তৎপরতা বৃদ্ধি পায়।

২০১৬ সালে হিজবুল মুজাহিদিন নেতা বুরহান ওয়ানির মৃত্যুর পর কাশ্মীরের পরিস্থিতি আরও অস্থির হয়ে ওঠে। বহু তরুণ স্থানীয়ভাবে জঙ্গি দলে যোগ দিতে শুরু করে। ২০১৮ সালেই ২৬০ জন জঙ্গি, ১৬০ জন বেসামরিক এবং ১৫০ জন নিরাপত্তা কর্মী প্রাণ হারান। এই পটভূমিতেই ঘটে পুলওয়ামা হামলার মতো ঘটনা।

হামলার পর ভারতজুড়ে প্রবল ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। রাজ্যে-রাজ্যে মোমবাতি মিছিল, প্রতিবাদ সভা এবং শহিদ জওয়ানদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলির আয়োজন হয়। সরকারিভাবে নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সাহায্য ও চাকরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়াও ছিল অত্যন্ত কঠোর। পাকিস্তানের “সর্বাধিক অনুকূল দেশ” মর্যাদা বাতিল করে তাদের পণ্যের উপর শুল্ক ২০০% পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়। একইসঙ্গে পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আর্থিক সন্ত্রাসে সহায়তা করার অভিযোগে ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (FATF)-এর ‘ধূসর তালিকা’তে রাখার আবেদন জানানো হয়।

এই ঘটনার পর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে থাকা কাশ্মীরি ছাত্রছাত্রী ও ব্যবসায়ীদের উপর একধরনের প্রতিশোধমূলক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। দেরাদুন, কলকাতা ও মেঘালয়সহ নানা জায়গায় কাশ্মীরিদের হেনস্থা ও বাড়ি থেকে উচ্ছেদের অভিযোগ ওঠে। তবে অনেক ভারতীয় নাগরিক এদের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।

পুলওয়ামা হামলার ১২ দিনের মাথায়, ২৬ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় বিমান বাহিনী পাকিস্তানের বালাকোটে জইশ-ই-মোহাম্মদের একটি প্রশিক্ষণ শিবিরে বিমান হামলা চালায়। ভারত দাবি করে, এই অভিযানে বহু জঙ্গি নিহত হয়েছে। যদিও পাকিস্তান এই দাবি অস্বীকার করে এবং পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ২৭ ফেব্রুয়ারি ভারতের আকাশসীমায় প্রবেশ করে। একটি মিগ-২১ যুদ্ধবিমান গুলি করে নামানো হয় এবং এর পাইলট অভিনন্দন বর্তমানকে বন্দি করে পাকিস্তান। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক চাপে পাকিস্তান তাকে মুক্তি দেয়।

হামলার তদন্তে উঠে আসে বিস্ফোরণে ব্যবহৃত বিস্ফোরক ছিল উচ্চমাত্রার আরডিএক্স ও অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট। এই বিস্ফোরক কোথা থেকে এল, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সেনা কর্মকর্তারা ধারণা করেছিলেন এটি স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা হতে পারে। হামলার মাসখানেকের মধ্যেই ভারতীয় সেনা অভিযান চালিয়ে আদিল দারের সহযোদ্ধা ও হামলার মূল পরিকল্পনাকারী পাকিস্তানি নাগরিক আবদুল রশিদ গাজী ও হিলাল আহমেদকে হত্যা করে।

পুলওয়ামা হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স সহ বহু দেশ এই ঘটনার নিন্দা করে এবং ভারতকে সমর্থন জানায়। জাতিসংঘেও এ নিয়ে আলোচনা হয়। ভারত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে জইশ-ই-মোহাম্মদের নেতা মাসুদ আজহারকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী হিসেবে ঘোষণার দাবি জানায়, যা পরে বাস্তবায়িত হয়।

পুলওয়ামা হামলারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, কাশ্মীরের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির এক জটিল মোড়ে দাঁড় করিয়ে দেয়। এই হামলার রক্তক্ষয়ী পরিণতি একদিকে যেমন বহু পরিবারকে শোকাহত করে, তেমনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।

r1 ad
top ad image