ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে অন্তর্বর্তী সরকার কি চাপে পড়বে?
বাংলাদেশে মার্কিন নির্বাচন নিয়ে যে আগ্রহ তার কেন্দ্রে আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে তার সাম্প্রতিক মন্তব্যে নতুন করে আলোচনা তৈরি হয়েছে। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে কি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার চাপে পড়বে?
বাংলাদেশ একটি পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আসা অন্তর্বর্তী সরকার নানা ধরনের সংস্কার কার্যক্রমের উদ্যোগ নিয়েছে। আছে নির্বাচনের তাগিদ। ড. ইউনূসের সরকারকে শুরু থেকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন। ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস নির্বাচনে জিতলে সেই সমর্থন অব্যাহত থাকবে বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষকেরা।
কিন্তু রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প জিতলে কী হবে? এই সমর্থন কি চলে যাবে? কূটনীতিকেরা অবশ্য তেমনটা মনে করেন না। তবে ট্রাম্পের ওপর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটা বড় প্রভাব আছে বলে তারা মনে করেন। তাতে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের এখন যে সম্পর্ক তাতে ট্রাম্প জিতলে নরেন্দ্র মোদি তাকে প্রভাবিত করতে চাইবেন। বিশ্লেষকদের মতে তার ফল এমন হবে না যে ট্রাম্প হাসিনা সরকারকে আবার বসাতে চাইবে।
মার্কিন নির্বাচন: ট্রাম্প-হ্যারিসের নীতি
সাবেক কূটনীতিক সাকিব আলি বলেন, ‘কমলা হ্যারিস মার্কিন প্রেসিডেন্ট হলে কী হবে তা বলা সহজ। কারণ তিনি জো বাইডেনের নীতির ধারাবাহিকতাই রক্ষা করবেন। তিনি ডেমোক্র্যাটদের নীতিই অনুসরণ করবেন। কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতায় আসলে ইইক্রেন যুদ্ধ যেকোনভাবে শেষ করবেন। তবে ইসরায়েল নীতি আরো কড়া হলে মধ্যপ্রাচ্যে সংকট আরো বাড়তে পারে।’
ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রচারের অন্যতম ইস্যু অভিবাসন। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবির মনে করেন তিনি জিতলে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন নীতিতে পরিবর্তন আসবে। এতে বাংলাদেশের অভিবাসী, সেখানে যেসব বাংলাদেশি ছাত্ররা পড়তে যান তাদের জন্য সমস্যা হতে পারে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের যারা ওখানে আছেন তারাও ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন। আর ট্রাম্প জিতলে রোহিঙ্গাদের জন্য আগের মতো তহবিল পাওয়া যাবে কি না তাও নিশ্চিত নয়।’ তবে ব্যবসা বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা নেই বলেই মনে করেন তিনি।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব) মো. শহীদুল হক বলেন ট্রাম্পের নীতি কেমন সেটি তার আগের মেয়াদ থেকে ধারণা পেয়েছে বিশ্ববাসী। বলেন, ‘পুতিনের মিত্র ট্রাম্প এবার বিশ্বকে কোন দিকে নেবেন সেটাই দেখার বিষয়৷ তিনি চান যুক্তরাষ্ট্রকে আরো ধনী করতে৷ তার আগ্রহ যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে।’
মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিস
ট্রাম্পের বক্তব্য ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট
ট্রাম্প সম্প্রতি তার এক্স বার্তায় লিখেছেন,‘আমি বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর বর্বরোচিত সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। দেশটিতে দলবদ্ধভাবে তাদের ওপর হামলা ও লুটপাট চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন পুরোপুরিভাবে একটি নৈরাজ্যকর অবস্থার মধ্যে রয়েছে।’
ট্রাম্পের এই বক্তব্য কি বাংলাদেশ সম্পর্কে তার বিদেশ নীতির প্রতিফল? ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা হুমায়ূন কবির বলেন, ‘এটা আসলে নীতির চেয়ে বড় হলো নির্বাচনে ভোটের ব্যাপার। মার্কিন নির্বাচনে ভারতীয় অভিবাসী এবং অভিবাসী হিন্দুদের একটা ভূমিকা আছে। ট্রাম্প তার কথা দিয়ে হয়তো তাদের ভোট টানতে চাইছেন। তার গত টার্মেও তিনি বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে কথা বলেছেন৷ তখন তো আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিল।’
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন সরকার পরিবর্তন হলেও মার্কিন বিদেশ নীতিতে সাধারণত বড় ধরনের পরিবর্তন হয় না। তবে ডেমোক্র্যাট আর রিপাবলিকানদের রাজনীতিতে পার্থক্য আছে। আছে নিজস্ব চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিও। সেই বিবেচনায় কমলা হ্যারিস ও ট্রাম্পের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। বাংলাদেশকে তা বিবেচনায় রাখতে হবে।
কূটনীতিক সাকিব আলি বলেন, ‘আবারো ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় আসলে, কমলা হ্যারিস মার্কিন প্রেসিডেন্ট হলে বাংলাদেশে বর্তমানে যে সরকার আছে তাদের জন্য সুবিধা হবে। তাদের তাদের সংস্কার কাজ, নির্বাচন এগুলো করা সহজ হবে৷ কারণ আগে থেকেই জো বাইডেন সমর্থন দিয়ে রেখেছেন।’
এক্ষেত্রে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসলে ইউনূস সরকারের সাথে মার্কিন প্রশাসনের এই সুসম্পর্ক নাও থাকতে পারে বলে তিনি মনে করেন। সাকিব আলি বলেন, ‘উনি (ট্রাম্প) যে সব উল্টে দেবেন তা আমি বলছি না। তবে বুঝতে হবে এই এলাকায় এখন বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত মুখোমুখি হয়ে গেছে। ট্রাম্প নির্বাচিত হলে তার পরিবর্তন হবে। মোদি ফ্যাক্টর কাজ করবে। কারণ ট্রাম্প আর মোদীর মধ্যে সম্পর্ক অনেক ভালো। তাই বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে।’
সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব) মো. শহীদুল হক বলেন, ‘ট্রাম্প জিতলে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটি ফ্যাক্টর হবেন। আর ট্রাম্পের সঙ্গে তার সম্পর্কের জন্য তিনি চাইবেন বাংলাদেশ নিয়ে ট্রাম্প যেন তার চিন্তায় চিন্তা করেন। সেটা পুরেপুরি হবে না। তারপরও মোদি চেষ্টা করবেন। তার প্রভাব পড়তে পারে। তাই বর্তমান সরকারকে রুটিন কূটনীতির মধ্যে থাকলে চলবে না। আরও সক্রিয় হতে হবে।’
বিশ্লেষকদের মতে, এরইমধ্যে বাংলাদেশকে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্টরা সক্রিয় আছেন। নির্বাচনের পর তারা আরও সক্রিয় হবেন। লবিস্টরা নানা বিষয়ে মার্কিন নীতিকে প্রভাবিত করতে পারেন।