কেন শেকল পরিয়ে অবৈধ অভিবাসীদের ভারতে পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র?

যুক্তরাষ্ট্র এ পর্যন্ত তিন দফায় অবৈধ অভিবাসীদের সামরিক বিমানে ভারতে পাঠিয়েছে । প্রথম দফায় ১০৪ জন, দ্বিতীয় দফায় ১১৭ জন এবং রোববার রাতে তৃতীয় দফায় ১১২ জন বেআইনি অভিবাসীকে ভারতে পাঠানো হয়। কূটনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্প আসলে এটা দেখানোর চেষ্টা করছেন, তিনি শুধু মেক্সিকো বা অন্য দেশের অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠাচ্ছেন তাই নয়, একইভাবে বন্ধু দেশ ভারতের বেআইনি অভীবাসীদেরও একইভাবে ফেরত পাঠাচ্ছেন।
প্রথম দফার মতো দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফাতেও অভিবাসীদের পাঠানো হয়েছে মার্কিন সামরিক বিমানে এবং তাদের হাতে হাতকড়া ও পায়ে শেকল বাঁধা ছিল। তবে প্রথমবারের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, নারী ও শিশুদের হাতকড়া ও বেড়ি পরানো হয়নি। তিনবারই বিমান নেমেছে অমৃতসরে।
যেভাবে পাঠানো হয়েছে
প্রথম দফায় যখন ১০৪ জন ভারতীয় হাতকড়া লাগিয়ে, পায়ে শেকল বেঁধে ফেরত পাঠানো হয়, তখন সংসদে প্রবল হইচই করেন বিরোধী দলগুলোর সাংসদরা। তারা কেউ বলেননি, এই ভারতীয়দের ফেরত পাঠানো অন্যায় হয়েছে। কিন্তু যেভাবে তাদের পাঠানো হয়েছে, তা নিয়ে তারা প্রতিবাদে মুখর ছিলেন।
তাদের বক্তব্য ছিল, ভারতে এই প্রথমবার হাতকড়া পরিয়ে, পায়ে শেকল বেঁধে অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠানো হয়েছে। যেভাবে পাঠানো হয়েছে, তাতে ভারতীয়দের মর্যাদাহানি করা হয়েছে। সরকার অবিলম্বে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে এই ভাবে ভারতীয়দের ফেরত পাঠানো বন্ধ করুক। কাউকে যেন হাতকড়া পরিয়ে, শেকলে পা বেঁধে পাঠানো না হয়।
বিরোধীদের প্রতিবাদ ও প্রশ্ন
কংগ্রেস সাংসদ রণদীপ সূরযেওয়ালা রাজ্যসভায় প্রশ্ন করেন, একটা সামরিক বিমানে পায়ে শেকল পরে, হাতে হাতকড়া লাগিয়ে, ১০৪ জন অবৈধ অভিবাসীকে ফেরত পাঠানো হলো। ৪০ ঘণ্টার যাত্রায় বিমানে একটা মাত্র টয়লেট ছিল, এরপরেও সরকার কেন চুপ করে বসে থাকলো?
কংগ্রেস সাংসদ প্রিয়াংকা গান্ধী সংসদ ভবনে সংবাদিকদের বলেন, শোনা যায়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প খুব ভালো বন্ধু। তাহলে মোদীজি কেন এটা হতে দিলেন? এভাবে কি মানুষের সঙ্গে ব্যবহার করা উচিত? তাদের কেন হাতকড়া পরিয়ে, পায়ে বেড়ি পরিয়ে ফেরত পাঠানো হবে?
কংগ্রেস-সহ বিরোধী দলের সাংসদরা সংসদ ভবনে বিক্ষোভ দেখান। তারা স্লোগান দেন, ভারতীয়দের এই অপমান সহ্য করা হবে না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এরপর সংসদে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এই প্রথমবার ভারতে অবৈধ অভিবাসীদের পাঠাচ্ছে না। এর আগেও পাঠিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ (আইসিই) ২০১২ সাল থেকে অভিবাসীদের স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর অনুসারে ফেরত পাঠায়। তারা জানিয়েছে, নারী ও বাচ্চাদের হাতকড়া বা শেকল বাঁধা হয়নি। তাদের খাবার ও প্রয়োজনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। টয়লেট যাওয়ার সময় তাদের হাতকড়া, শেকল খুলে দেয়া হয়েছে।
জয়শংকর বলেন, ''আমরা যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলব। তাদের বলব, অভিবাসীদের যেন বিমানে কোনোরকম খারাপ ব্যবহার না করা হয়।'' তিনি বলেছেন, ''অভিবাসীরা অমৃতসরে পৌঁছাবার পর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেছেন। কোন এজেন্টের সাহায্যে তারা গেছিলেন, কীভাবে গেছিলেন, সব জানা হয়েছে।''
জয়শঙ্করের বক্তব্য, এই বেআইনি অভিবাসী এজেন্টদের কড়াভাবে মোকাবিলা করতে হবে। আইনরক্ষকরা সেই কাজ করবেন।
ভারত কেন প্লেন পাঠাবে না?
তৃণমূল সাংসদ সংসদে বলেছিলেন, ''কলম্বিয়া এইভাবে অভিবাসীদের ফেরত পাঠানো মেনে নেয়নি। তারা নিজেরা মর্যাদার সঙ্গে অভিবাসীদের ফেরত পাঠাতে নিজেদের বিমান পাঠিয়ে নিয়ে এসেছে।'' প্রিয়াংকা গান্ধী বলেছেন, ''ভারত কি নিজের বিমান পাঠাতে পারতো না?"
বিজেপি মুখপাত্র সঞ্জু বর্মা ইন্ডিয়া টুডেকে বলেছেন, ''উদ্বাস্তু, শরণার্থী এবং এবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে তফাৎ আছে। অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা ইচ্ছে করে আন্তর্জাতিক আইন, প্রটোকল ভেঙেছে। ওরা কি রাহুল গান্ধীর আত্মীয়, জামাই? ওদের জন্য এরকম দাবি কেন করছেন রাহুল? এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক প্রটোকল আছে। ট্রাম্প প্রশাসন আন্তর্জাতিক রুলবুক মেনে চলেছে।''
কংগ্রেস নেতা সঞ্জয় ঝা বলেছেন, ''পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা শুনে আমার মাথা লজ্জায় নত হয়েছে। যারা এই দেশ ত্যাগ করে যাচ্ছে, তাদের মনে হয়েছে, এই দেশে তাদের ভবিষ্যৎ নেই। আমাদের দেশের মানুষ যাদের ভারতীয় বিমান আনতে পারত, তাদের এইভাবে আনা হলো। আমরা এভাবে পা শেকলে বেঁধে, হাতে হাতকড়া পরিয়ে ভারতীয়দের আনার বিষয়টি সমর্থন করব?''
পরিস্থিতির বদল হয়নি
এরপর শনিবার ও রোববার দুই দফায় আরো ২২৯ জন ভারতীয় অবৈধ অভিবাসীকে একইভাবে ফেরত পাঠিয়েছে আমেরিকা। তার আগে ওয়াসিটনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেছেন, ''অভিবাসী-- প্রশ্নটা শুধু ভারতকে নিয়ে নয়। যে কোনো দেশ থেকেই বেআইনিভাবে কেউ ঢুকলে তার সেখানে থাকার কোনো অধিকার নেই। কোনো ভারতীয় ঢুকলে বেআইনিভাবে আমরা তাকে নিতে প্রস্তুত।''
মোদী বলেছেন, ''এখানেই বিষয়টি শেষ হচ্ছে না। যারা এভাবে আসছে, তারা সাধারণ পরিবারের সন্তান। তারা প্রতিশ্রুতি ও লোভে পড়ে যায়। তারা একটা সিস্টেমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। আমরা চেষ্টা করব, এই সিস্টেমকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে। মানব পাচার যাতে না হয়., সেটা নিশ্চিত করব।''
তিন দফায় অবৈধ অভিবাসীদের পায়ে শেকল ও হাতে হাতকড়া পরিয়ে ফেরত পাঠানোর পর কংগ্রেস সাংসদ জয়রাম রমেশ বলেছেন, ''এখন এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে প্রধানমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী তার প্রিয়. বন্ধুকে জানাননি, ভারতীয় নাগরিকদের এইভাবে ফেরত পাঠানোর ফলে দেশের মানুষ কতটা ক্ষুব্ধ। শুধুমাত্র ভিরুরাই ৫৬ ইঞ্চি ছাতির বরাই করে।''
প্রবীণ সাংবাদিক ও কূটনীতি বিশেষজ্ঞ প্রণয় শর্মা ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ''অবৈধ অভিবাসীরা কেউ অপরাধী নন। তাদের এইভাবে অপমান করাটা মেনে নেয়া যায় না। আমেরিকার নিয়ম থাকতেই পারে। কিন্তু মানবিক মর্যাদার একটা বিষয়ও আছে।''
প্রণয় মনে করছেন, ''ট্রাম্প আসলে এটা দেখানোর চেষ্টা করছেন, তিনি শুধু মেক্সিকো বা অন্য দেশের অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠাচ্ছেন তাই নয়, একইভাবে বন্ধু দেশ ভারতের বেআইনি অভীবাসীদেরও একইভাবে ফেরত পাঠাচ্ছেন। তবে অতীতে দেখা গেছে, ট্রাম্প কোর্স কারেকশন করেন। এক্ষেত্রে করবেন কিনা সেটা দেখার।''
ফেরত পাঠানোর খরচ
সামরিক বিমানে অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর বিপুল খরচ রয়েছে। বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের রিপোর্ট অনুসারে একেকবার ১০ লাখ ডলার খরচ করে অবৈধ অভিবাসীদেদের ভারতে পাঠানো হচ্ছে। এই বিমানে একঘণ্টার উড়ানের জন্য লাগে ২৮ হাজার ৫৬২ ডলার। সাধারণ যাত্রীবাহী বিমানে করে পাঠাতে খরচ অনেক কম লাগে।