অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন জানিয়ে জাতিসংঘের চিঠি\n
এই ঘটনার ‘নিরপেক্ষ তদন্ত’, ‘ন্যায় বিচার’, ‘দোষীর শাস্তি’, এবং হাসপাতালে নিরাপত্তাসহ বেশ কয়েকটা দাবি নিয়ে প্রতিবাদে শামিল হয় সেই নিহত চিকিৎসকের কলেজের সহপাঠী এবং অন্যান্য জুনিয়র চিকিৎসকরা।
প্রতিবাদে একে একে সামিল হন সাধারণ মানুষ, নাগরিক সংঠন, ছাত্র, দেশের অন্যান্য প্রান্তের ডাক্তার, চিকিৎসাকর্মীসহ আরও অনেকে। আন্দোলন মিলিয়ে দিয়েছে ফুটবল মাঠে ইস্ট বেঙ্গল ও মোহনবাগানের সমর্থকদের, মিলিয়ে দিয়েছে বাঙালি-ঘটির পুরানো রেষারেষিকে। এই দুই দলের সঙ্গে যোগ নিহত চিকিৎসকের জন্য বিচার চেয়ে প্রতিবাদে স্বর মিলিয়েছেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের অনেক সমর্থকও।
আবার এই আন্দোলনই ঘুঁচিয়ে দিয়েছে দিয়েছে সীমানার কাঁটাতার যে কারণে প্রতিবাদের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে।
পার্কস্ট্রিট, কামদুনি, মধ্যমগ্রামে একের পর এক যে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে তাতেও প্রতিবাদ হয়েছে, মিছিল হয়েছে, প্রশাসনের বিরুদ্ধে কণ্ঠ জোরালোও হয়েছে কিন্তু আরজি করের ঘটনার পর যে তীব্রতা দেখা গিয়েছে, তা নজিরবিহীন বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু আন্দোলনের এত তীব্রতা কেন আর কেনই বা এত জনরোষ?
‘মানুষের পিঠ ঠেকে গেলে এটাই হয়। পার্কস্ট্রিট থেকে শুরু করে পরপর যে কটা ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা হয়েছে সেখানে হয় ঘটনাকেই অস্বীকার করা হয়েছে, নির্যাতনের শিকারকেই দায়ী করা হয়েছে। কোথাও বিরোধীদের চক্রান্ত বলা হয়েছে কোথাওবা দোষীদের আড়াল করার চেষ্টা চলেছে। এইসব দেখতে দেখতে মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। আরজি করের ঘটনার হাত ধরে সেই সব ক্ষোভ, বিতৃষ্ণা রাজপথে চলে এসেছে,’ বলেছেন হাওড়ার বাসিন্দা সৌম্য গাঙ্গুলি।
এ বিষয়ে সহমত পোষণ করেন বিশ্লেষকরাও। সমাজকর্মী ও অধ্যাপক শাশ্বতী ঘোষ বলেন, ‘শাসকদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের যে ক্ষোভ ছিল, তা সামনে চলে এসেছে।’
অনেকে মনে করেন ক্ষমতাসীন সরকারের আমলে একের পর এক দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসার বিষয়টিও এই আন্দোলনের তীব্রতার পিছনে রয়েছে।
‘বিচার চাইলে সব ধামা চাপা দেওয়া হয়’
শিক্ষিকা এবং ফেমিনিস্ট অ্যাক্টিভিস্ট শতাব্দী দাশ বলেন, ‘আসলে এই যে কিছু হলেই বলা হয় তুমি কেন অত রাতে ওখানে গিয়েছিলে? কেন এমন পোশাক পরেছ, উল্টে ভিক্টিমদেরই দোষারোপ করার বিষয়টা বন্ধ হওয়া দরকার। ক্ষমতা প্রদর্শন করতে ধর্ষণ করা, বিচার চাইলে সব ধামা চাপা দেওয়া- এগুলো তো দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এটা বন্ধ হওয়া দরকার।’
এই সব ভেবেই রাত দখলের কর্মসূচিতে যোগদান করেন তিনি এবং আরও অনেককে যোগ দিতে উৎসাহ দেন এই ইংরেজির শিক্ষিকা।
নৈহাটির বাসিন্দা মধুবন চক্রবর্তী স্বতঃস্ফূর্তভাবে আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে যোগ দিয়েছেন। রাত দখলের কর্মসূচি চলাকালীন, মিছিলে পা মেলানোর বদলে প্রতিবাদের অন্য ভাষা দেখা গিয়েছিল। প্রায় নির্জন ‘রাস্তা দখল’ করে একা বসেছিলেন তিনি। বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এই আগুন সহজে নেভার নয়। কারণ এটা একদিনে তৈরি হয়নি। মানুষের সহ্যের একটা সীমা আছে, সেই বাঁধ কিন্তু ভেঙ্গে গিয়েছে।’
বিষয়টি আরও একটু ব্যাখ্যা করতে নিজের কথা বলেছেন তিনি । মধুবন চক্রবর্তী বলেন, ‘আমাকেই যদি জিজ্ঞাসা করেন, আজ থেকে পাঁচ-ছয় বছর আগে, এই কথাগুলো এভাবে বলার মতো আমার সাহস ছিল কি? উত্তর হলো- না। আজ আছে, তার একটা কারণ আমি লেখাপড়া করেছি, জেনেছি আমার কী অধিকার আছে, স্বাধীনতা সম্পর্কে সচেতন হয়েছি। তাই প্রশাসনকে বলতে পারছি তোমরা আমাকে আমার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছ, তোমরা নিজেদের দায়িত্ব পালন করছ না। আর অন্য একটা কারণ হলো আমাদের পিঠ ঠেকে গিয়েছে।’
আইনের এই ছাত্রী জানিয়েছেন তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা। তিনি বলেন, ‘সিনিয়রদের সঙ্গে আদালতে গিয়ে প্রায় রোজই দেখি ধর্ষণের কোনো-না-কোনো মামলা রয়েছে। ঘটনার ভয়াবহ নৃশংসতা ভাবতে বাধ্য করে এই মেয়েটির জায়গায় আমিও থাকে পারতম।’
এই ‘রিলেট’ করতে পারার বিষয়টাও মানুষকে এগিয়ে আসতে বাধ্য করেছে বলে মনে করেন অনেকে।
‘মানুষ এই ঘটনার সঙ্গে নিজের পরিস্থিতিকে মেলাতে পারছেন। তারা বুঝতে পারছেন এই ঘটনা যে কারোর সঙ্গে ঘটতে পারে এবং ঘটেও। বিচার এত সহজে মিলবে না। তারা বুঝেছে নিজেদের অধিকার নিজেদেরই বুঝে নিতে হবে,’ এমনটাই মনে করেন চিত্রশিল্পী প্রদোষ পাল।
এই প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন তারাও। অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস-এ তিনি এবং অন্যান্য চিত্র শিল্পীরা সমবেত হয়ে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে মানুষের মনে ক্ষোভ জমে রয়েছে। বাম জমানাতে কিছু হয়নি এমনটা নয়। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের সময়েও মানুষ প্রতিবাদ জানিয়েছেন। রিজওয়ানুর রহমানের অস্বাভাবিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে পথে নেমেছিলেন সাধারণ মানুষ। আসলে তাদের কাছে কোনও রাজনৈতিক বিকল্প নেই আর সেই ফায়দাই যে দলগুলো নিচ্ছে সেটা তারা জানেন। সেই জনরোষ জমা হতে হতে এই আকার ধারণ করেছে।’
ভিন্ন ভিন্ন কণ্ঠস্বর কীভাবে সমবেত হলো?
আরজি কর হাসপাতালের রেসিডেন্ট ডক্টর এবং সেখানকার আন্দোলনরত চিকিৎসকদের অন্যতম অনিকেত মাহাত বলেন, “আমাদের একজন চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন সত্যিই আমাদের সাহস জুটিয়েছে। মানুষ সংবেদনশীল। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে যে ক্ষোভ জমেছে তা প্রকাশের পথ পাচ্ছিলেন না। এই ঘটনার হাত ধরে তারা এগিয়ে এসেছেন।
একই কথা বলেছেন, ফুটবলপ্রেমী ও মোহনবাগান দলের সমর্থক সুরঞ্জন মুখার্জী। তার মতে, যেখানে কলকাতা রক্তাক্ত, সেখানে কোনও ভেদাভেদ বা অন্য কিছু মাথায় না রেখে সমবেত হয়ে প্রতিবাদ জানানোটাই আমরা করণীয় বলে মনে করেছি। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকেরা এত বছরের দ্বন্দ্ব, ট্রোল সব কিছু ভুলে একসঙ্গে গলা মিলিয়েছিল তার একটাই কারণ আমরা আরজি করের জন্য বিচার চাই।
প্রসঙ্গত, রাত দখলে লাখ লাখ মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যোগ দেওয়ার পর রোববার এক নজিরবিহীন দৃশ্যের সাক্ষী থেকেছে কলাকাতা । মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গলের ফুটবল ম্যাচ থাকলে যে সমর্থকরা মুহূর্তে দলকে কেন্দ্র করে ‘ভাগ’ হয়ে যান, সেই সমর্থকেরাও একজোট হয়ে প্রতিবাদ জানাতে জড়ো হয়েছিলেন রোববার বিকেল থেকে। বৃষ্টি, পুলিশের বাধা কিছুই নিরস্ত করতে পারেনি তাদের।
এর আগে, পুলিশের পক্ষ থেকে ‘সুরক্ষাজনিত’ কারণ দেখিয়ে রোবারের ডার্বি ম্যাচ বাতিল করে দেওয়া হয়। সূত্রের খবর স্টেডিয়ামে প্রতিবাদ রুখতেই এই সিদ্ধান্ত, যদিও প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছিল।
কিন্তু প্রতিবাদ থামেনি, বরং জোরালো হয়। রোববার সারে ৩টা বাজতে না বাজতে ফুটবলপ্রেমীরা দল নির্বিশেষে একত্রিত হন, বিচার চান নিহত চিকিৎসক ও সহনাগরিকের, প্রশ্ন তোলেন কেন ডার্বি ম্যাচ হলো না শহরে। যোগ দিয়েছিলেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের অনেক ফুটবলপ্রেমীও। প্রতিবাদীদের অনেকের উপর পুলিশ লাঠি চালায় বলে অভিযোগ। সেখানে একে অপরকে রক্ষা ভিন্ন ভিন্ন দলের সমর্থকদের।
‘ফুটবল ম্যাচ হলে আমরা গ্যালারিতে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ জানাব বলে ঠিক ছিল। কিন্তু ম্যাচ বাতিল হয়ে যাওয়ায় আমরা ঠিক করি স্টেডিয়ামের বাইরে আমরা প্রতিবাদ জনাব,’ বলেছেন ইস্ট বেঙ্গলের সমর্থক সৌরিশ পাল। কিন্তু তার অভিযোগ, পুলিশের তরফে এই জমায়েত না করার কথা বলা হয়।
নিয়ম মেনে প্রতিবাদে শামিল হয়েও পুলিশের হাতে মার খেতে হয় অনেক সমর্থককে। ‘আমাদের জানানো হয়েছিল পুলিশি নিরাপত্তা কারণে ডার্বি বাতিল হয়েছে। কিন্তু ওই এলাকাতে যে পরিমাণে পুলিশ উপস্থিত ছিল, তার অর্ধেক থাকলে ম্যাচ হয়ে যেত। আমরা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করেছি। পুলিশকে আক্রমণ করিনি, কুরুচিকর মন্তব্য করিনি তাও আমাদের উপর লাঠি চালানো হয়, সমর্থকদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এত অতিসক্রিয়তা আরজি করের ভাঙচুরের দিন কোথায় ছিল?’ প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। আর ঠিক এই প্রশ্নগুলোর হাত ধরেই ক্ষোভ ধীরে ধীরে বেড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
সমাজবিদ এবং অধ্যাপক শাশ্বতী ঘোষের মতে, ‘আরজি করের ঘটনাই মানুষের মনে একটা জনরোষ তৈরি করেছে। ৩৬ ঘণ্টা ডিউটি করার পর একজন চিকিৎসকের সঙ্গে তারই প্রতিষ্ঠানে এমন ঘটনা ঘটতে পারে এইটাই জনরোষের প্রধান কারণ। দ্বিতীয়ত, ঘটনার শুরু থেকে পুলিশ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভূমিকা যেখানে বোঝা যাচ্ছে তারা কিছু ধামা চাপা দিতে বা কাউকে বাঁচাতে চাইছে।’
‘তৃতীয়ত, আরজি করে হামলার দিন পুলিশের ভূমিকা। এবং আন্দোলন থামাতে আর জি করের চারদিকে ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতার ১৬৩ ধারা জারি করা, রোববার ফুটবল সমর্থকদের উপর বল প্রয়োগ-এই সমস্ত মিলে মানুষের মনে তীব্র অসন্তোষ তৈরি করেছে।’
এই পরিস্থিতির সঙ্গে মানুষ কোথাও একটা যোগাযোগ খুঁজে পাচ্ছেন বলে মনে করেন তিনি। ‘স্কুলের বাচ্চা থেকে প্রাপ্তবয়স্ক সবাই ভাবছেন কিছু একটা করি তার একটাই কারণ, তাদের মনে হচ্ছে বিচার পাচ্ছে না এবং এটা আমাদের সঙ্গেও হতে পারে। তারা নিজেদের সঙ্গে বিষয়টাকে রিলেট করতে পারছেন। আসলে সাধারণ মানুষের প্রশাসনের এবং বিচার ব্যবস্থার উপর বিশ্বাস ফিরছে না।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বলেন, ‘শাসকদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের কিন্তু বেশ ক্ষোভ আছে। কারণ একটা নির্বাচনও নিরপেক্ষভাবে হয়নি। বহু জায়গায় ভোট লুঠ হয়। তাই আসলে শাসকের প্রতি কতটা জনসমর্থন আছে তা জানা যায় না। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের প্রভাব রয়েছে বলে আমার মনে হয়।’
অন্যদিকে, মানবাধিকার সংঠন এপিডিআর এর সাধারণ সম্পাদক রঞ্জিত শূর মনে করেন শিক্ষাক্ষেত্র নিয়োগ দুর্নীতি, রেশন দুর্নীতি, নারী নির্যাতন-সহ একাধিক বিষয় এই আন্দোলনের কারণ।
‘এই তীব্র আকারের আন্দোলন তো আর একদিনে হয়নি। মানুষ চোখের সামনে একেরপর এক দুর্নীতি দেখেছে। নিয়োগ দুর্নীতি, শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতির মতো বিষয় সাধারণ মানুষকে বিশেষত যুব ও ছাত্র সমাজের উপর প্রভাব ফেলেছে। এর পাশাপাশি একের পর এক নারী নির্যাতনের ঘটনা এবং এই সমস্ত দুর্নীতিতে শাসক ও পুলিশের ভূমিকা মানসূহের মধ্যে তীব্র জনরোষ তৈরি করেছে।’
শাসকদল কি অস্বস্তিতে?
এই প্রতিবাদ পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল সরকারকে ‘অস্বস্তিতে’ ফেলেছে কী? এর উত্তরে রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বলেন, ‘শাসককে যদি মানুষ ভয় না পায় তাহলে তো শাসকের দুশ্চিন্তার কারণ আছে বৈকি। কারণ তার শাসন ব্যবস্থা শেষ হয়ে যাবে।’
মানবাধিকার আন্দোলনের দীর্ঘদিনের এই কর্মী আবার সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। তার কথায়, ‘এই যে আরজি কর হামলার ঘটনার পর পুলিশের অতিসক্রিয়তা, ফেসবুকে, এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট করলেই সমন পাঠানো এই সবই তো প্রমাণ করে কতটা অস্বস্তিতে রয়েছে শাসকদল।’