top ad image
top ad image
home iconarrow iconবিশ্ব রাজনীতি

কে এই তুলসী গ্যাবার্ড?

কে এই তুলসী গ্যাবার্ড?
মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান তুলসি গ্যাবার্ড। ছবি: পলিটিকো

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তুলে এবং ইসলামিক খেলাফত নিয়ে মন্তব্য করে আলোচনার ঝড় তুলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ড। নাম দেখে অনেকের ধারণা, তিনি ভারতীয় বা ভারতীয় বংশোদ্ভূত। আসলেই কি তাই? আসুন, এই প্রভাবশালী নারী সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

তুলসীর জন্ম ১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আমেরিকান সামোয়ায়। তার মায়ের নাম ক্যারল পোর্টার গ্যাবার্ড, বাবা মাইক গ্যাবার্ড। ১৯৮৩ সাল থেকে তারা হাওয়াইয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

তুলসীর রাজনীতিতে হাতেখড়ি বেশ কম বয়সেই। ২০০২ সালে যখন তিনি ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে হাওয়াইয়ের প্রতিনিধি পরিষদে আসন জয় করেন, তখন তার বয়স মাত্র ২১ বছর। ওই সময় সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসবে অঙ্গরাজ্যের আইনসভায় জায়গা করে নেন তুলসী।

যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণের পর তুলসী হাওয়াই আর্মি ন্যাশনাল গার্ডে যোগ দেন। ২০০৪ সালে তিনি প্রতিনিধি পরিষদ থেকে পদত্যাগ করে ইরাকে একটি চিকিৎসা ইউনিটের দায়িত্ব নেন। পরের বছর যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে এলে তাকে কমব্যাট মেডিকেল ব্যাজ সম্মাননায় ভূষিত করা হয়।

তুলসী এরপর পড়ালেখা করেন অ্যালাবামা মিলিটারি একাডেমিতে। ২০০৭ সালে তার স্নাতক শেষ হয়। ২০০৮ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি কুয়েতে অবস্থিত সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিটে প্রশিক্ষণ দেন। তিনি হাওয়াই প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটিতে ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা নিয়ে পড়ালেখা করেন এবং ২০০৯ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।

২০২০ সাল পর্যন্ত ন্যাশনাল গার্ডে থাকা তুলসী ওই বছরই যোগ দেন মার্কিন আর্মি রিজার্ভে। এর মধ্যে ২০১৩ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিনি ডেমোক্রেটিক পার্টির কংগ্রেস সদস্য ছিলেন। ২০২০ সালে ডেমোক্র্যাট পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ারও চেষ্টা করেছেন। তবে সফল হননি। পরে ২০২২ সালে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি থেকে পদত্যাগ করে ২০২৪ সালে রিপাবলিকান পার্টিতে যোগ দেন তিনি। ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক হিসেবে তুলসীকে নিয়োগ দেন।

নাম তুলসী হলেও তিনি নিজেই পরিষ্কার করে বলেছেন, তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত নন। তবে তিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বী।

প্রকৃতপক্ষে তুলসীর মা ক্যারল গ্যাবার্ড একটি বহুসাংস্কৃতিক পরিবারে বড় হয়েছিলেন। তিনি হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি তার পাঁচ সন্তানের নাম রাখেন—ভক্তি, জয়, আর্য, তুলসী ও বৃন্দাবন। তুলসীও মায়ের ধর্মই গ্রহণ করেন। তুলসীই প্রথম হিন্দু ব্যক্তি যিনি যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান হিসেবে নিয়োগ পেলেন।

যেভাবে আলোচনায় তুলসী?

সংখ্যালঘু নির্যাতন ও ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড যে মন্তব্য করেছেন, তা দিয়েই দেশ জুড়ে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে তার নাম। তার এসব বক্তব্য নিয়ে তৈরি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। এ বক্তব্যকে ‘বিভ্রান্তিকর’ অভিহিত করে সরকার বলছে, তার এই বক্তব্য বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করেছে।

তবে সংখ্যালঘু হিন্দু নেতাদের অভিযোগ, এর মাধ্যমে সরকার প্রকৃত সত্যকে উপেক্ষা করছে। অন্যদিকে অন্তবর্তী সরকারের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে ইসলামপন্থিরা ভারতের গণমাধ্যম ও তুলসী গ্যাবার্ডের কঠোর সমালোচনা করেছেন।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের তদন্ত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ সংবামাধ্যমকে বলেন, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন ও ধর্ষণের ঘটনা চলমান। গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত দুই হাজার ১০টি সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ৯ জন নিহত হন।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে মনীন্দ্র কুমার নাথ বলেন, একই বছরের ২১ আগস্ট থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৭৪টি সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় অন্তত ২৩ জন নিহত হন।

এর মধ্যে অবশ্য গত ১২ জানুয়ারি সরকারের প্রেস উইংয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গত ৪ আগস্টের পর সাম্প্রদায়িক হামলা বলে দাবি করা ঘটনার মধ্যে এক হাজার ২৩৪টি ঘটনা রাজনৈতিক ও ২০টি ছিল সাম্প্রদায়িক। কমপক্ষে ১৬১টি দাবি মিথ্যা বা অসত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আক্রমণগুলো সাম্প্রদায়িকভাবে অনুপ্রাণিত ছিল না, বরং রাজনৈতিক প্রকৃতির ছিল।

আগস্টের পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর সংঘটিত আক্রমণ ধর্মীয় নয়, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে সফররত যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর গ্যারি পিটার্সকে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসও। গ্যারি পিটার্স মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

তবে মনীন্দ্র কুমার নাথ দাবি করেন, এগুলো ছিল ‘টার্গেটেড কিলিং’। তার মতে,‍ দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান বলেছেন সাম্প্রদায়িকতা চলছে। শুরু থেকে আমরাও বলে আসছি, এ দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চলছে। এটি বন্ধ হওয়া দরকার।

তবে হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির মাওলানা মহিউদ্দিন রব্বানী বলেন, মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান সঠিক তথ্য পরিবেশন করেননি। এটি খুবই দুঃখজনক।

দেশের জাতীয় দৈনিকে গত এক-দুই মাসে সংখ্যালঘু নির্যাতনের তেমন কোনো খবর নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা এখানে সংখ্যালঘু বুঝি না। আমরা সবাই বাংলাদেশি। আমরা সব ধর্মাবলম্বী সহাবস্থানে সুন্দরভাবে জীবনযাপন করছি।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে মার্কিন গোয়েন্দা প্রধানের বক্তব্যকে অসত্য ও দুরভিসন্ধিমূলক বলে মন্তব্য করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব ও দলীয় মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, তুলসী গ্যাবার্ড বাংলাদেশ সম্পর্কে একগুচ্ছ মিথ্যা ও দুরভিসন্ধিমূলক বক্তব্য দিয়ে ভারতকে খুশি করার অপচেষ্টা করেছেন। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক কিছু হানাহানি হলেও তাতে যে সাম্প্রদায়িক কোনো ইস্যু ছিল না, তা সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত সত্য।

তুলসীর বক্তব্য ও সরকারের প্রতিক্রিয়া

তুলসী গ্যাবার্ডের মন্তব্য প্রতিক্রিয়ায় সোমবার রাতে এক বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় বলেছে, মার্কিন গোয়েন্দা প্রধানের এমন মন্তব্যের পেছনে কোনো তথ্যপ্রমাণ কিংবা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই।

বিবৃতিতে বলা হয়, “বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও চরমপন্থার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। কিন্তু আইন প্রয়োগ, সামাজিক সংস্কার ও সন্ত্রাসবিরোধী অন্যান্য প্রচেষ্টার মাধ্যমে এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অংশীদারত্বের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে।’

প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় বলেছে, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিপীড়ন ও হত্যা এবং দেশে ইসলামিক সন্ত্রাসীদের হুমকি সম্পর্কিত মন্তব্য সঠিক নয় এবং বাংলাদেশের সুনাম ও ইমেজের জন্য বিভ্রান্তিকর এবং ক্ষতিকর।

যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাপ্রধান তুলসী গ্যাবার্ড বাংলাদেশ সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, তাতে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক সম্পর্কে প্রভাব পড়বে না বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা।

অন্যদিকে তুলসী গ্যাবার্ডের মন্তব্য নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবস্থান জানতে চাইলে মঙ্গলবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবস্থানও সেটাই। তবে তুলসী গ্যাবার্ডের বক্তব্য ‘গুরুতর’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তুলসী গ্যাবার্ডের যে বক্তব্য নিয়ে এত হইচই, সেই বক্তব্য তিনি মূলত দিয়েছিলেন ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভি ওয়ার্ল্ডকে। ভারতে সফররত তুলসীর ওই সাক্ষাৎকার গত সোমবার প্রকাশ করে এনডিটিভি ওয়ার্ল্ড।

সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তুলসী বলেন, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর দীর্ঘদিনের দুঃখজনক নির্যাতন, হত্যা ও নিপীড়নের ঘটনা মার্কিন সরকার এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার প্রশাসনের একটা বড় উদ্বেগের জায়গা।

এ সময় ‘ইসলামি খিলাফত’ প্রসঙ্গ তুলে তুলসী বলেন, ‘চরম ইসলামপন্থিদের হুমকি ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বৈশ্বিক যে প্রচেষ্টা, তাদের সবার শেকড় একই আদর্শ ও উদ্দেশ্যে মিশেছে। তাদের সে উদ্দেশ্য হলো ইসলামি খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা।’

[ব্রিটানিকা ও দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়াসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম অবলম্বনে]

r1 ad
r1 ad
top ad image