বিজ্ঞান
ডার্ক ম্যাটার ও কুইন্টেসেন্স থিওরি
একদিকে আপেক্ষিকতা অন্যদিকে কোয়ান্টাম মেকানিকস—কখনো আলাদাভাবে, কখনো হাত ধরাধরি করে গত এক শ বছর ধরে এগিয়ে নিয়েছে পদার্থবিদ্যার বিশ্বটাকে। হ্যাঁ, অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনো মেলেনি। সত্যি বলতে কি পদার্থবিদ্যার এই দুই তত্ত্ব সব প্রশ্নের জবাব দিতে অক্ষম। তাই বহুদিন ধরেই বিজ্ঞানীরা করে চলেছেন বিকল্প তত্ত্বের সন্ধান। কিন্তু মেলেনি।
বিকল্প তত্ত্ব মেলেনি কিন্তু এই দুই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠে নতুন নতুন অনেক তত্ত্ব। গড়ে উঠেছে কোয়ান্টাম ফিল্ড থিয়োরি, স্ট্যান্ডার্ড মডেল কিংবা সুপারসিমেট্রি মতো তত্ত্বও। ডার্ক এনার্জিকে ব্যাখ্যা করার জন্য বিজ্ঞানীরা এমনই এক নতুন তত্ত্ব দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন।
সেই তত্ত্বটার তত্ত্বটার নাম কুইন্টেসেন্স থিওরি। কুইন্টেন্সের ভালো বাংলা হচ্ছে ‘সারাংশ’। বাংলা নামটা তত্ত্বটার জন্য একদম মানানসই নয়। তাই আমরা এক কুইন্টেসেন্স থিওরিই বলব।
এই তত্ত্বের প্রবক্তা ভারতীয়-আমেরিকান বিজ্ঞানী ভারত বিষ্ণু রত্র আর কানাডিয়ান-আমেরিকান জেমস পিবলস। যিনি ২০১৯ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন পদার্থবিজ্ঞানে।
এই নতুন তত্ত্ব কেন?
প্রথম কারণ, ডার্ক এনার্জির উত্স কী, সেটা আমরা জানি না। কেনই বা ডার্ক এনার্জি বিকর্ষণী চরিত্রের, তাও আমরা জানি না। আইনস্টাইনের মহাজাগতিক ধ্রুবকের সঙ্গে ডার্ক এনার্জির মিলটাই বা কোথায়? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই কুইন্টেসেন্স তত্ত্বের উদ্ভব।
রত্র আর পিবলসের মতে কুইন্টেসেন্স ফিল্ড হলো একটা নতুন ধরনের কোয়ান্টাম ফিল্ড বা ক্ষেত্র। অর্থাৎ কুইন্টেসেন্স তত্ত্বও এক ধরনের কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব। কিন্তু ডার্ক এনার্জিকে যদি একটা কোয়ান্টাম ক্ষেত্রের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্ব অনুযায়ী যেকোনো কোয়ান্টাম ক্ষেত্র ছড়িয়ে থাকে গোটা মহাবিশ্বজুড়ে। যেমন বিদুত্চুম্বকীয় ক্ষেত্র, দুর্বল ও সবল নিউক্লিয় বলক্ষেত্র কিংবা হিগস ক্ষেত্র। প্রতিটা কোয়ান্টাম ক্ষেত্রেই থাকে ভ্যাকুয়াম এনার্জি, যেটাকে শূন্যস্থানের শক্তি বলে। সমস্যা হলো এই ভ্যাকুয়াম এনার্জি নিশ্চল। কুইন্টেসেন্স যদি কোয়ান্টাম ক্ষেত্র হয় আর সেই কোয়ান্টাম ক্ষেত্রের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে যে কোয়ান্টাম শক্তি সেটা নিশ্চয়ই ডার্ক এনার্জি। কিন্তু ডার্ক এনার্জি তো নিশ্চল নয়, রীতিমতো ত্বরিত গতিতে প্রসারিত হচ্ছে। এর সমাধান কী?
আসলে কুইন্টেসেন্স তত্ত্বটা এখনো একটা হাইপোথিসি মাত্র। একে পুরোপুরি কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরির সঙ্গে মেলাতে গেলে ভুল হবে। আবার মহাজাগতিক ধ্রুবককেই অনেক বিজ্ঞানী ডার্ক এনার্জি হিসেবে চালিয়ে দিতে চেয়েছেন, এই ব্যাপারটাও মানে না কুইন্টেসেন্স তত্ত্ব। কারণ মহাজাগতিক ধ্রুবক আইনস্টাইন জন্ম দিয়েছিলেন মহাবিশ্বকে স্থির রাখবার জন্য। সেই ধ্রুবকই যদি কোনো শক্তি হবে, সেটার মানও তাহলে স্থির থাকবে। কিন্তু ডার্ক এনার্জি স্থির নয়। সময়ের সঙ্গে ডার্ক এনার্জি বেড়েই চলেছে। তাই মহাবিশ্ব ত্বরিত হারে প্রসারিত হচ্ছে। কুইন্টেসেন্স তত্ত্ব বলে ডার্ক এনার্জির জন্য দায়ী যে বস্তুটা, যার নাম কুইন্টেসেন্স, সেটা এর বিভবশক্তি ও গতিশক্তির অনুপাতের ওপর নির্ভর করে বির্কষর্ণী আর কিংবা আকর্ষণী দুই চরিত্রের হতে পারে। এই তত্ত্বের মতে এই কুইন্টেসেন্স বা ডার্ক এনার্জি চিরকাল বিকর্ষণী চরিত্রের ছিল না। আজ থেকে এক হাজার কোটি বছর আগে এটা বিকর্ষণী হিসেবে আবির্ভূত হয় আর তখন থেকেই ত্বরিত গতিতে সম্প্রসারিত হতে শুরু করে মহাবিশ্ব। অর্থাৎ কুইন্টেসেন্স নামের বলক্ষেত্রের কারণেই মহাবিশ্ব ত্বরিত বেগে সম্প্রসারিত হচ্ছে।
মহাবিশ্বের শক্তির উত্স হলো বস্তু আর বিকিরণ। এই দুই উত্স থেকে যে ধরনের শক্তি পাওয়া যায়, কুইন্টেসেন্স তার থেকে একদমই আলাদা। এমনকি ডার্ক ম্যাটারের সঙ্গেও ডার্ক এনার্জির এর মিল নেই। এই ডার্ক এনার্জির উত্স কী? বিজ্ঞানীরা মনে করেন এর পেছনেও রয়েছে এক ধরনের ম্যাটার। সেই ম্যাটারটির নামই কুইন্টেসেন্স।
বিজ্ঞানীরা বলছেন আমাদের মহাবিশ্বের জ্যামিতিটা ফ্ল্যাট বা সমতল। আমরা দেখেছিলাম মহাবিশ্বের মোট ভর ঘনত্ব যদি মহাবিশ্বের ক্রান্তীয় ভর ঘনত্বের সমান হয় তখন Ω-এর মান ১ হবে। তাহলে মহাবিশ্ব হবে ফ্ল্যাট। এ ধরনের মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হয়েই চলবে। সুপারনোভা অনুসন্ধানী বিজ্ঞানীরা বলেন মহাবিশ্বের জ্যামিতি সমতল। পরে মহাকাশে ডার্ক এনার্জি অনুসন্ধান করে যেসব টেলিস্কোপ থেকে যেসব ডাটা পাওয়া যায়, সেগুলোতেও মহাবিশ্বের জ্যামিতি সম্পর্কে একই তথ্য দিয়েছে। সেই সমতল মহাবিশ্ব যে ত্বরিতগতিতে প্রসারিত হয়ে চলেছে, সেটার জন্য দায়ী সেই বিপুল পরিমাণ ডার্ক এনার্জি।
ম্যাটার বা বস্তুর কারণেই জন্ম মহাকর্ষ বলের। আর মহাকর্ষ বল সবসময় আকর্ষণী চরিত্রের। কিন্তু ডার্ক এনার্জি সবসময় বিকর্ষণী চরিত্রের। বিজ্ঞানীরা বললেন কুইন্টেসেন্স এমনই এক বস্তু তার থেকে যে বলের জন্ম হবে সেটাও বিকর্ষণী চরিত্রের। বিজ্ঞানীরা বলছেন কুইন্টেসেন্স সাধারণ পদার্থের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে। তবে তার ধরন সাধারণ পদার্থের ধরনের থেকে উল্টো। এজন্যই এই মিথস্ক্রিয়ার ফল আমরা বিকর্ষণী চরিত্রে দেখি। এই বিকর্ষণী চরিত্রের ডার্ক এনার্জি মহাবিশ্বের বাকি এক তৃতীয়াংশ ভর-শক্তি অর্থাৎ দৃশ্যমান ম্যাটার আর ডার্ক ম্যাটারদের ওপরে ক্রিয়া করে। সেই ক্রিয়ার ফল কী হবে?
সাধারণ ভরশক্তির তুলনায় ডার্ক এনার্জির পরিমাণ তিনগুণ। অথচ উম্যাপের (WMAP) ডাটা থেকে দেখা যায়, মহাবিশ্বের শুরুর দিকে ডার্ক এনার্জি বলে কিছুই ছিল না। দৃশ্যমান পদার্থ, নিউট্রিনো আর ফোটনের পরিমাণ অনেক বেশি ছিল। কিন্তু বর্তমান পরিপেক্ষিতে দেখায় যায় আকাশ-পাতাল পার্থক্য। জন্মের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ডার্ক এনার্জির পরিমাণ বেড়েই চলেছে, পক্ষান্তরে কমেই চলেছে দৃশ্যমান ভর-শক্তির পরিমাণ।
এই পার্থক্য কী ইঙ্গিত করে?
ডার্ক এনার্জির বিকর্ষণী শক্তির পাল্লায় পড়ে ক্রমেই সাধারণ পরমাণুগুলো ভেঙে গুড়িয়ে যেতে থাকবে, এক সময় উধাও হয়ে যাবে সমস্ত গ্যালাক্সি আর নক্ষত্রেরা?
ডার্ক এনার্জিরা যদি সত্যিই ভ্যাকুয়াম এনার্জি হত, তাহলে এটাই ঘটার কথা। তবে সেটা সূদুর অতীতে ডার্ক এনার্জি সত্যি সত্যিই ভ্যাকুয়াম এনার্জির মতো হলে অনেক আগেই মহাবিশ্বের সমস্ত ম্যাটার ধ্বংস হয়ে যেত। তাই ডার্ক এনার্জির ঠিক ঠিক চরিত্র বোঝার জন্য কুইন্টেসেন্স তত্ত্ব ভরসা হয়ে উঠেছে।
কুইন্টেসেন্স থিওরিও গড়ে উঠেছে ইনফ্লেশনের মতো একটা ব্যাপার থেকে। কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি অনুযায়ী, মহাবিশ্বের জন্মের পর একটা ইনফ্লেশন বা স্ফীতের মধ্য দিয়ে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ শুরু হয়। কুইন্টেসেন্স থিওরি অনুযায়ী কুইন্টেসেন্স ইনফ্লেশনটা ঠিক কোয়ান্টাম ইনফ্লেশনের মতো নয়। এইন্স ইনফ্লেশনের শক্তি অনেক দুর্বল প্রকৃতির। কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরিতে প্রতিটা কোয়ান্টাম ফিল্ডের সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি করে কণা আর কোয়ান্টাম ক্ষেত্র। কোয়ান্টাম ফিল্ড বা ক্ষেত্রের কম্পন থেকেই জন্ম হয় কোয়ান্টাম কণিকাদের। কুইন্টেসেন্স থিওরিতেও একটা সতন্ত্র কুইন্টেসেন্স ফিল্ড থাকবে। আর সেই ফিল্ডের কম্পনের ফলেই জন্ম হয় কুইন্টেসেন্স কণাদের। কুইন্টেসেন্স ফিল্ডের শক্তি অনেক দুর্বল, তাই এর কম্পনও অনেক দুর্বল প্রকৃতির। দুর্বল কম্পনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনেক বেশি হয় আর কম্পাঙ্ক হয় অনেক কম। কুইন্টেসেন্স ফিল্ডের কম্পনও অনেক দুর্বল প্রকৃতির। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা অনুযায়ী প্রতিটা কোয়ান্টাম কণিকার তরঙ্গ আর কণা দুই সত্ত্বাই থাকে। কুইন্টেসেন্স কণাদেরও তাই তরঙ্গ চরিত্র থাকবে। কিন্তু শক্তি কম বলে সেই কণাদের তরঙ্গ দৈর্ঘ অত্যন্ত বেশি হবে। এদের কম্পাঙ্ক হবে খুবই কম। আর এ ধরনের কণাদের আকার কিন্তু বিশাল।
কতটা বড় এই কণিকা। কুইন্টসেন্স তত্ত্ব বলছে এই কণিকাদের আকার হবে একেকটি বিশাল সুপারক্ল্যাস্টারদের মতো। আর এই রহস্যময় কুইন্টেসেন্স ফিল্ডের ভেতরেই লুকিয়ে আছে ডার্ক এনার্জির প্রাণ ভোমরা। এর বিকর্ষণী চরিত্রও লুকিয়ে আছে ডার্ক এনার্জির বিকর্ষণী চরিত্রের ব্যাখ্যা। কিন্তু এই তত্ত্ব এখনো হাইপোথেটিক্যাল পর্যায়ে। বিজ্ঞানীরা জটিল এই তত্ত্বটিকে ব্যাখ্যা করার জন্য আরও গবেষণা চালাবেন। অদূর ভবিষ্যতে যদি কুইন্টেসেন্স থিওরি প্রমাণিত হয়, তাহলে ডার্ক এনার্জির সকল রহস্য উনোমচিত হবে। এমনকি ডার্ক এনার্জিদের ধোঁয়াসাও দূর হয়ে যাবে।
সূত্র: ফিজিকস ওয়ার্ল্ড