বিজ্ঞান
যেভাবে ব্যাটারি এলো
ইতালিয়ান বিজ্ঞানী লুইজি গ্যালভনি পেশায় ছিলেন চিকিৎসক। আর চিকিৎসকদের কত জন্তুজানোয়ার কাটাকুটি করে গবেষণা করতে হয়। গ্যালভনিও করেতন। বিশেষ করে ব্যাঙ কাটতেন তিনি।
১৭৭৮ সাল। গ্যালভনি একদিন একটা ব্যাঙ কেটে রেখে দিয়েছিলেন টেবিলের ওপর। তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন অন্যকাজে।
গ্যালভনির এক সহকারী একটা ধাতব ছুরি দিয়ে ব্যাঙটাকে কেন জানি স্পর্শ করেন। আর তাতেই নড়ে ওঠে মরা ব্যাঙের একটা পা। সহকারী ভয় পেয়ে যান। বলেন গ্যালভনিকে। তিনিও ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখেন। ফল একই। প্রথমে গ্যালভনিও ভয় পেয়ে যান। ভাবেন যেকোনোভাবে হয়তো মরা ব্যাঙের শরীরে প্রাণ ফিরে এসেছে!
কীভাবে প্রাণ ফিরে এলো?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে গ্যালভনি করলেন প্রচুর গবেষণা। এক সময় নিশ্চিত হলেন, ব্যাঙের শরীরে আসলে প্রাণ ফিরে আসেনি। ততোদিনে যা রটার রটে গেছে। ব্যাপারটা নিয়ে একটা আর্টিকেল লিখে ছাপিয়েছিলেন গ্যালভনি। তাতেই সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের মধ্যে সাড়া পড়ে যায়। এ নিয়ে জন্ম হয় নানারকম হাস্যকৌতুকের। আসলে মৃত ব্যাঙের শরীরে প্রাণ ফেরানো সম্ভব নয়। ব্যাপারটা সবাই বুঝেছিলেন। তাই মজা করে গ্যালভনির নাম দিয়েছিলেন ব্যাঙ নাচানো বিজ্ঞানী।
কিন্তু এর সঙ্গে ব্যাটারির কি সম্পর্ক?
গ্যালভনি দ্রুতই বঝতে পারেন, ব্যাঙের নড়ে ওঠার কারণ বিদ্যুৎ। তিনি শুধু ছুরি নয়, তামার তারসহ নানা রকম ধাতব জিনিস দিয়ে মরাব্যাঙের শরীর স্পর্শ করালেন। একই ফল পেলেন।
এই বিদ্যুৎ কোত্থেকে এলো?
সেকালের বিজ্ঞানীরা আজকালকার মতো কারেন্ট বা চল বিদ্যুতের কথা জানতেন না। তবে স্থির বিদ্যুৎতের কথা জানতেন। যেমন মাথার চুলে চিরুনি ঘষলে স্থির বিদ্যুতের জন্ম হয়। তখন সেই চিরুনি কাগজের ছোট ছোট টকুরোকে আকর্ষণ করতে পারে।
গ্যালভনির বাড়িতে স্থির বিদ্যুৎ তৈরির একটা যন্ত্র ছিল। প্রথম দিকে তাই তিনি ভেবেছিলেন, ওই যন্ত্র থেকে বিদ্যুৎ এসে হয়তো মরাব্যাঙের দেহ নাচিয়ে দিচ্ছে। পরে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নিশ্চিত হন, এ ধারণা ভুল। বাগানে একটা লোহার শিক ছিল। সেই শিকেও ব্যাঙ ঝুলিয়েছিলেন গ্যালভনি। তখননো দেখলেন, ঝুলন্ত ব্যাঙের দেহটাও নড়ে উঠল।
এখানে বিদ্যুৎ কোত্থেকে এলো?
গ্যালভনি হিসাব করে দেখলেন আকাশে বিদ্যুৎ চমকালেও তার থেকে কিছু বিদ্যুৎ নেমে আসে পৃথিবীতে। বিদ্যুৎ না চমকালেও বাতাসের ভেতরেই হয়তো স্থির বিদ্যুৎ লুকিয়ে আছে। তখন নিশ্চিত হওয়ার উপায় ছিল না। কিন্তু এখন আমরা জানি, সৌরঝড়ের কারণে তৈরি হওয়া আয়ন বায়ুর প্রভবে বাতাসে যথেষ্ট পরিমাণ স্থির বিদ্যুৎ তৈরি হয়। এছাড়া দূর মহাকাশ থেকে আসা মহাজাগতিক রশ্মিতেও যথেষ্ট পরিমাণ আয়নিত কণা থাকে। প্রতিটা আয়ন কণা আসলে একেকটা বিদ্যুতের আধার।
বাতাসের প্রভাবেই ধাতব বস্তুতে বিদ্যুৎ জমা হতে পারে। এমনটাই ভেবেছিলেন গ্যালভনি। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, দুটো আলাদা ধাতু দিয়ে ব্যাঙের দেহ এক সঙ্গে স্পর্শ করলে ব্যাঙটা বেশ ভালোভাবে নড়ে ওটে। তবে তিনি শুধু স্থির বিদ্যুতের কথাই ভাবেননি। তিনি আরেক ধরনের বিদ্যুতের কথাও ভেবেছিলেন। সেটা হলো জৈব বিদ্যুৎ। তিনি অনুমান করেছিলেন দুটো ধাতব তার স্পর্শ করলে ব্যাঙের শরীরর থেকে জৈববিদ্যুৎ মুক্ত হয়। তারই ফলে ব্যাঙের দেহ নড়ে ওঠে।
আসলে নিজের অজান্তেই গ্যালভনি প্রথমবারের মতো ব্যাটারি আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। কীভোবে সে ব্যাখ্যায় পরে আসি।
ব্যাঙ নাচানোর ব্যাপারটাতে বিদ্যুতের কারসাজি পুরোপুরি বুঝতে পারেননি গ্যালভনি। কিন্তু তার সমসাময়িক আরেক ইতালিয়ান বিজ্ঞানী ঠিকই বুঝলেন। তার নাম আলসান্দ্রো ভোল্টা। তিনি প্রথমে জৈববিদ্যুতের ব্যাপারটা মেনেই কাজ করছিলেন। কিন্তু আর গভীরভাবে পরীক্ষা করে দেখেন ব্যাঙ বা কোনো প্রাণীর দেহ এখানে মুখ্য নয়। বিদ্যুৎ তৈরির জন্য দরকার একটা ভেজা মাধ্যম। ব্যাঙের বদলে যেকোনো ভেজা জিনিস ব্যবহার করে তার দু মাথায় দুটো ধাতব জিনিস লাগিয়ে দিলেই বিদ্যুৎ পাওয়া যায়।
তিনি নানা কিছু দিয়ে পরীক্ষা করলেন। এরপর তিনি লবণ কিংবা ক্ষার মেশানো ভেজা জিনিস দিয়ে পরীক্ষা করেও একই ফল পেলেন।
ভোল্টা তার এই সিস্টেমের গুরত্ব বুঝেছিলেন। তােই তিনি জিনিসটা আরও উন্নত করার চেষ্টা করলেন। ব্যাঙের বদলে তিনি ব্যবহার করলেন একটা কাগজের চাকতি। সেটা ভেজালেন লবণ মেশানো পানি দিয়ে।
চাকতির একপাশে একটা তামার পাত আরেক পাশে একটা দস্তার পাত জুড়ে একটা যন্ত্র তৈরি করলেন। শুধু একটা নয়। বিশ-ত্রিশটা যন্ত্র তৈরি করলেন। তারপর একটার দস্তার পাত আরেকটা তামার পাতের সঙ্গে একই ক্রমে সবগুলে জুড়ে দিলেন। বিদ্যুৎপরিবাহী তার দিয়ে। সবগুলো যখন জোড়া শেষ তখন পুরো সিস্টেমটার একদিকে একটা মুক্ত তামার পাত থাকল, অন্যদিকে একটা মুক্ত দস্তার পাত থাকল। সবটা মিলে তৈরি হলো একটা ব্যাটারি। ভোল্টা মুক্ত তামার আর দস্তার পাত দুটোকে একটা তার দিয়ে জুড়ে দিয়ে দেখলেন, আগুনের স্ফূলিঙ্গ দেখা যায়।
ভোল্টা বুঝলেন, তামার ও দস্তার মুক্ত পাত দুটো সরাসরি যুক্ত না করে এদের মাঝখানে যদি কোনো বৈদ্যুতিক যন্ত্র রাখা যায়, তাহলে সেটা বেশ কাজ করবে। ব্যাস এভাবেই তৈরি হলো পৃথিবীর প্রথম ব্যাটারি।
এরপর সময়ের সঙ্গে এই ব্যাস্থার আরও উন্নতি ঘটলেন বিজ্ঞানীরা। এখনো চার্জার ফ্যান, মোটরগাড়ি বা এই ধরনের বড় বড় জিনিসগুলোতে যেসব বড় বড় ব্যাটারি দেখা যায়, সেগুলোর মূল কৌশল ওই গ্যালভনির আর ভোল্টার থেকে পাওয়া। অর্থাৎ আজ যে আমরা বিদ্যুৎ সঞ্চয় করে রাখার জন্য যতরকম ব্যাটারি দেখি, সেগুলোর আদী সংস্করণ হলো একটা মৃত ব্যাঙ।
সূত্র: ব্রিটানিকা