top ad image
top ad image
home iconarrow iconফিচার

বিজ্ঞান

বিজ্ঞানের হাফলাইফ

বিজ্ঞানের হাফলাইফ
প্রতিটা তেজস্ক্রিয় পরমাণুর নির্দিষ্ট হাফলাইফ থাকে

নিউক্লিয়ার বোমা কিংবা পারমাণবিক বিদ্যুৎ– যেখানেই নিউক্লিয়ার শক্তির আনাগোনা, সেখানেই হাফলাইফ বা অর্ধায়ু গুরত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ হয়ে ওঠে। কিন্তু এই হাফলাইফটা কী, সেটা কি আমরা জানি?

জানতে হলে চোখ ফেরাতে হবে, ইতিহাসের পাতায়। ১৯০৭ সালে রাদারফোর্ড তেজস্ক্রিয় মৌলদের অর্ধায়ুতত্ত্ব দাঁড় করান। তেজস্ক্রিয় মৌলের পরমাণুগুলো ভেঙে যায়। কেন ভাঙে সে প্রশ্নের উত্তর তখন ছিল না? বিজ্ঞানীরা সে প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তখনই সেটা জানা সম্ভব হয়নি।

তখন আরেকটা প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দেয়। বিশেষ করে রাদারফোর্ডের কাছে। কখন কোন পরমাণুটা ভাঙতে শুরু করবে?

রাদারফোর্ড তো জবাব পানইনি, আজ পর্যন্ত মেলেনি উত্তর। কখনো পাওয়া যাবেও না।

কারণ, মৌলের তেজস্ক্রিয় ভাঙন হয় র‌্যান্ডমভাবে। একটা নির্দিষ্ট সময়ে কয়টি পরমাণু ভাঙবে, সেটা আপনি বলতে পারবেন; কিন্তু কোন পরমাণু কখন ভাঙবে, সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না।

২.

কোনো মৌল তেজস্ক্রিয় ভাঙনের পর সরাসরি স্থিতিশীল মৌলে পরিণত হয় না বললেই চলে। বেশির ভাগ মৌলই মধ্যবর্তী আরও এক বা একাধিক তেজস্ক্রিয় মৌলে পরিণত হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মূল তেজস্ক্রিয় মৌলের চেয়ে মধ্যবর্তী তেজস্ক্রিয় মৌলের ভাঙন হয় একটু দ্রুতই।

মধ্যবর্তী মৌলগুলো তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ করে স্থিতিশীল অতেজস্ক্রিয় মৌল তৈরি করে। এ কারণে ভাঙন শুরু হওয়ার পরপরই ভাঙনের হার সময়ের সঙ্গে কমতে থাকে। এর ফলে কমতে থাকে তেজস্ক্রিয় পরমাণুর সংখ্যা এবং বাড়তে শুরু করে স্থিতিশীল পরমাণুর সংখ্যা।

এভাবে চলতে থাকলে দেখা যাবে তেজস্ক্রিয় বস্তুটিতে তেজস্ক্রিয় পরমাণুর সংখ্যা একসময় অর্ধেক হয়ে গেছে। আর বাকি অর্ধেক পরিণত হয়েছে স্থিতিশীল মৌলে। এই যে তেজস্ক্রিয় পদার্থের অর্ধেকে পরিণত হওয়া, এর জন্য যতটুকু সময় লাগে, সেই সময়টাকেই রাদারফোর্ড বললেন অর্ধায়ু। এই অর্ধায়ু কিন্তু সব মৌলের সমান নয়। তেজস্ক্রিয়তার হার একেক মৌলের একেক রকম। তাই এদের অর্ধায়ুর মধ্যেও পার্থক্য আছে। তবে মোদ্দা কথা হলো, রাদারফোর্ড একটা সমীকরণ দাঁড় করালেন।

সেই সমীকরণ যেকোনো তেজস্ক্রিয় মৌলের অর্ধায়ু বের করা যায়। সমীকরণটা হলো T1/2 = 0.693/λ. এখানে T1/2অর্ধায়ু, λ হলো তেজস্ক্রিয় ক্ষয় ধ্রুবক। ক্ষয় ধ্রুবক প্রতিটা মৌলের জন্য আলাদা। তাই কোনো মৌলেরই অর্ধায়ু আরেকটার সঙ্গে মিলবে না। ইউরেনিয়ামের অর্ধায়ু ৪৫০ কোটি বছর। অন্যদিকে থোরিয়ামের অর্ধায়ু ২৪ দিন, রেডিয়ামের ১৬০০ বছর আর ফ্রান্সিয়াম-২২০-এর অর্ধায়ু মাত্র সাড়ে ২৭ সেকেন্ড! তার মানে আপনি তেজস্ক্রিয় বিকিরণের গ্রাফ দেখলে একেক বস্তুর কার্ভ একেক রকম দেখবেন! একটার সঙ্গে অন্যটার ফারাক আকাশ-পাতাল। তবে যে যত উঁচুতেই বাস করুক, রাদারফোর্ডের সমীকরণের জালে তাকে আটকা পড়তেই হবে। তাই ৪৫০ কোটি বছরের হিসাব যেমন নিখুঁতভাবে বের করা যায়, তেমনি মাত্র ২৭ সেকেন্ডের হিসাব বের করতে বিজ্ঞানীদের বেগ পেতে হয় না।

অর্ধায়ু নিয়ে সবচেয়ে মজার ব্যাপারটিতে আসা যাক। হিসাবটা আমরা থোরিয়াম দিয়ে করি। ধরা যাক, আপার কাছে একটা থোরিয়ামের আকরিক আছে। তাতে এক শটা তেজস্ক্রিয় পরমাণু আছে। এ অবস্থায় আপনি তেজস্ক্রিয় পরিমাপ শুরু করলেন। ঠিক ২৪.১ দিন পরে দেখবেন, থোরিয়াম ওই যৌগটি অর্ধায়ুতে পৌঁছে গেছে। অর্থাৎ আপনি এখন পর্যবেক্ষণ করলে দেখবেন, আকরিকে পঞ্চাশটা থোরিয়াম পরমাণু অক্ষত আছে। অন্য পঞ্চাশটা তেজস্ক্রিয় ভাঙনের ফলে পাল্টে অন্য পরমাণুতে পরিণত হবে।

অর্ধায়ু নিয়ে অনেকের মধ্যেই ভুল ধারণা আছে। তাঁরা ভাবেন, এই যে ২৪.১ দিনে থোরিয়াম অর্ধেক পরমাণুতে পরিণত হলো, তাহলে আরও ২৪.১ পর বাকি পঞ্চাশটা মৌলে ভাঙন ধরবে এবং সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হবে। এখানেই আসলে মজা! আপনি যদি আরও ২৪ দিন অপেক্ষা করেন, তাহলে দেখবেন, পঁচিশটা পরমাণুতে ভাঙন ধরেছে, অক্ষত রয়েছে বাকি পঁচিশটা পরমাণু। এভাবে আপনি তৃতীয় অর্ধায়ু পেরিয়ে দেখবেন ১২.৫টা পরমাণু অক্ষত আছে। যদিও ০.৫টি পরমাণুর হিসাব কষা যায় না কণা লেভেলে। সে ক্ষেত্রে ১২টা কিংবা ১৩টা পরমাণু অক্ষত পাবেন। ধরা যাক, আপনি ১২টা পেলেন।

তাহলে আরও একটা অর্ধায়ু পার করে দেখবেন, ৬টা পরমাণু অক্ষত আছে। এভাবে পঞ্চম অর্ধায়ুর পর ৩টি, ষষ্ঠ অর্ধায়ুর পর ১.৫ (আসলে ১ অথবা ২টি) পরমাণু অক্ষত পাবেন। তাত্ত্বিকভাবে এভাবে চলতে থাকবেই, কখনোই তেজস্ক্রিয় ক্ষয় শেষ হওয়ার কথা নয়। তবে পরীক্ষণ কিন্তু তা বলে না। পরীক্ষণ বলে, আপনার হাতে একসময় মাত্র ১টি পরমাণু থাকবে। তার পরের অর্ধায়ুতে গিয়ে আর কোনো অক্ষত পরমাণু পাবেন না। তবে থোরিয়ামের যে আকরিক নেবেন, তাতে যদি ১০০টার বদলে কয়েক লাখ পরমাণু থাকে, তাহলে আপনি আরও অনেক বেশি অর্ধায়ু হয়তো পাবেন, কিন্তু অনন্তকাল ধরে চলবে না। কিন্তু থোরিয়ামের বদলে যদি ইউরেনিয়ামের আকরিক নিয়ে পরীক্ষা করেন, তাহলে হিসাবটা কিন্তু উল্টে যাবে। ১০০টা পরমাণুরও দরকার নেই, মাত্র ১০টা পরমাণু নিয়েই পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পারেন। কিন্তু পর্যবেক্ষণ করাটা অসম্ভব। কারণ, ইউরেনিয়ামের অর্ধায়ু ৪৫০ কোটি বছর।

তাই বাস্তব পর্যবেক্ষণ না করতে পারলেও গাণিতিক পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। রাদারফোর্ডের হিসাব বলবে ১০টা পরমাণু ভেঙে ৫টাতে পরিণেত হতে সময় লাগবে ৪৫০ কোটি বছর। সেই ৫টা পরমাণুর ২টা অথবা ৩টা ভাঙতে সময় লাগবে আরও ৪৫০ কোটি বছর। তারপর আরও ৪৫০ কোটি বছর পর আপনি মাত্র একটা পরমাণু অক্ষত পাবেন। কিন্তু সূর্যের আয়ুই যেখানে ১ হাজার কোটি বছর, সেখানে তিনটা অর্ধায়ু পর্যন্ত যেতে ইউরেনিয়াম সময় নেবে ১ হাজার ৩৫০ কোটি বছর! নিশ্চয়ই ইউরেনিয়ামের আকরিকে মাত্র ১০টি পরমাণু থাকে না। সেটা বরং কয়েক কোটি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাই মনে হতেই পারে ইউরেনিয়ামের ভাঙন অনন্তকাল ধরে চলতে পারে।

তাই খুব ভালো হয় যদি ফ্রান্সিয়াম নিয়ে পরীক্ষা করেন। অতি বড় একটা আকরিক নিয়ে পর্যবেক্ষণ করলেও দেখবেন, মাত্র কয়েক সেকেন্ড/ঘণ্টা/দিনের মধ্যেই স্রেফ ‘নেই’ হয়ে গেছে! তাই প্রকৃতিতে এ ধরনের তেজস্ক্রিয় মৌল পাওয়া খুব কঠিন। গবেষণাগারেই তৈরি হয় এসব তেজস্ক্রিয় মৌল। তারপরও কিছু কিছু মৌল পাওয়া যায় প্রকৃতিতে। এর কারণ, এগুলো ঠিক পৃথিবীর জন্মের সময় তৈরি হয়নি। এগুলো তৈরি হয়েছে অন্য কোনো দীর্ঘজীবী তেজস্ক্রিয় মৌলের তেজস্ক্রিয় ভাঙনের ফলে।

সূত্র: নিউ সায়েন্টিস্ট

r1 ad
r1 ad