top ad image
top ad image
home iconarrow iconফিচার

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কণাদের অনিশ্চিত ধর্ম

কণাদের অনিশ্চিত ধর্ম
কোয়ন্টাম জগতে কণাদের চরিত্র অনিশ্চয়তায় ভরা

আমাদের দৈনন্দিন জীবন চলে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র মেনে, গণিতের হিসাব মিলিয়ে। তাই কোনো কাজ করার আগে ঠিকঠাক হিসাব কষে নিলেই হয়। আগাম জেনে যাবেন, কাজের ফলাফল। কিন্তু খুদে কণাদের যে অদ্ভুত জগৎ, সেখানে সাধারণ গণিতের নিয়ম খাটে না। সেখানকার জগৎটাই অনিশ্চয়তার মোড়া। আর সেই অনিশ্চিত জগতের রূপকার এক শ বছর আগের এাকঝাঁক ইউরোপিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী।

কণিকাদের কণা-তরঙ্গের দ্বৈত নীতি বাতলে দিয়েছিলেন ফরাসি বিজ্ঞানী লুই দ্য ব্রগলি। তিনি কি জানতেন তাঁর তত্ত্বের ওপর খবরদারি করতে এসে বিজ্ঞানের ইতিহাস পাল্টে দেবেন এক জার্মান তরুণ—ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ? অনিশ্চয়তার ঘেরাটোপে বন্দী হয়ে হাঁসফাঁস করবে বলবিদ্যার জগৎ।

তখন অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী সাই (Ψ) নামের এক ত্রিশূলে বিদ্ধ করলেন পদার্থবিজ্ঞানের চিরচেনা নীতিগুলোকে।

হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতিরই আরেক রূপ হলো শ্রোডিঙ্গারের এই তরঙ্গ সমীকরণ। সেই সমীকরণে সাই নামে একটা ফাংশন জন্ম দেন শ্রোডিঙ্গার। সাইয়ের মানের ওপরে নির্ভর করে কোনো এক বিন্দুতে কোয়ান্টাম কণাদের পাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু। অর্থাৎ সাই হলো অনিশ্চয়তার সবচেয়ে বড় চিহ্ন।

কোয়ান্টাম জগৎ যত অনিশ্চিত হোক, যতই দ্বিচারিণী হোক কোয়ান্টাম কণারা, এদের তরঙ্গ ফাংশনকে কোথাও না কোথাও ভেঙে পড়তে হয়। তার মানে এই নয় সাইয়ের ভেঙে পড়ায় কোয়ান্টাম জগতের সাথে নিউটনীয় বলবিদ্যার সম্পর্ক তৈরি হবে। বরং তরঙ্গ ফাংশন সাই আরও অদ্ভুত এবং ব্যাখ্যার অতীত সব চিত্র তুলে ধরবে।

ইয়ংয়ের ডাবল স্লিটের আদলে ইলেকট্রন নিয়েও করা হয়েছিল ব্যতিচার পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় অনেকগুলো কণা ব্যবহার করা হয়েছে।

কণাদের তরঙ্গ ও কোন ধর্মের ব্যাপারটাও বোঝা সহজ হয়েছে অনেকখানি। কিন্তু অনেকগুলো কণা না হয়ে যদি এখানে একটা কণা নেওয়া হতো, ধরা যাক সেটা ইলেকট্রন—তাহলে কী ঘটত?

একটিমাত্র ইলেকট্রন নিয়ে ডাবল স্লিটের পরীক্ষা করতে গেলে এমন সব ফলাফল পাবেন তাতে গুলিয়ে যাবে আমাদের বাস্তব বিচারবুদ্ধি। মনে হবে কোয়ান্টাম জগতের আসলে মায়া, বাস্তবতাবিবর্জিত এক কল্পকাহিনির জগৎ যেন। কিন্তু সেই মায়াবী কল্পকাহিনি সেই অদ্ভুত আইন ব্যবহার করেই আমাদের নিত্যদিনের নানা কর্মকা- পরিচালিত হচ্ছে।

ইয়াংয়ের ডবল স্লিটের মতো একটা ব্যবস্থা তৈরি করুন। যেখানে দুটো ফুটো থাকবে একটা দেয়ালে। ফুটোর পাশে থাকবে একটা পর্দা। সেই পর্দায় ব্যতিচার প্যাটার্ন তৈরি হবে। এবার একটা ইলেকট্রন ছেড়ে দিন। ধরুন সেই ইলেকট্রনটি ছুটে যাবে দেয়ালের ফুটোর দিকে।
ফুটো দুটো, ইলেকট্রন একটা।

তাহলে দেয়াল পার হওয়ার জন্য ইলেকট্রনটা কোন ছিদ্র বেছে নেবে। কোয়ান্টাম সুপারপজিশন অধ্যায়ে আমরা দেখে এসেছি, ইলেকট্রনের নির্দিষ্ট কোনো গতিপথ নেই। একটা বিন্দু থেকে আরেকটা বিন্দুতে যাওয়ার জন্য এদের সম্ভাব্য অনেকগুলো পথ আছে। সেই পথের যেকোনো একটিকে তারা বেছে নিতে পারে। সুতরাং ডাবল স্লিটের পরীক্ষায় ইলেকট্রন দুটি ফুটোয় ব্যবহার করতে পারবে। আবার যেকোনো একটি ব্যবহার করতে পারবে। এখন আপনি যদি ইলেকট্রনকে ছেড়ে দিয়ে আর কোনো হস্তক্ষেপ না করেন তাহলে ফুটো দুটো ওপাশে যে পর্দা আছে তার ওপর একটা ব্যতিচার প্যাটার্ন দেখতে পাবেন। তার মানে ইলেকট্রনটি একই সাথে দুটি পথ ব্যবহার করেছে এবং এসেছে তরঙ্গ আকারে। কিন্তু আপনি যদি একটি ফুটো বন্ধ করে দেন তাহলে অন্য ফুটো দিয়ে ইলেকট্রন গিয়ে পর্দার ওপর পড়বে। তখন আর ব্যতিচার প্যাটার্ন তৈরি হবে না। ইলেকট্রনটি তখন কণার মতো গিয়ে পর্দায় আঘাত করবে।

কিন্তু আমরা বলে এসেছি কোয়ান্টাম কণার আপনার মেজাজ-মর্জি বুঝতে পারে। তাই আপনি যেমন চান ওরা সেভাবেই আপনার কাছে ধরা দেবে। সেটা আপনি কণা চাইলে কণা, তরঙ্গ চাইলে তরঙ্গ রূপে পাবেন। কিন্তু এই পরীক্ষায় আপনি একটু অন্য রকমভাবে চাইবেন। আপনি দেখতে চাইবেন কোনটা কোন পথে যায় এবং কীভাবে যায়।

একটা যন্ত্র নিন। সেই যন্ত্রটা শনাক্ত করবে ইলেকট্রন ফুটোর ভেতর দিয়ে গেছে কি যায়নি। যন্ত্রটা বসান যেকোনো একটি ছিদ্রের সামনের। তারপর একটা ইলেকট্রন ছেড়ে দিন। এ ক্ষেত্রে দেয়ালের দুটো ফুটোই খোলা থাকবে। তারপরও আপনি অবাক হয়ে দেখবেন, ফুটোর ওপাশে কোনো ব্যতিচার প্যাটার্ন তৈরি হয়নি। তার মানে ইলেকট্রনটি শুধু যে ফুটোয় আপনি যন্ত্র বসিয়েছেন সে ফুটো দিয়ে গেছে। যেহেতু সে একটা ফুটো দিয়ে গেছে তাই সে কণার মতো আচরণ করবে, ফুটোর ও পাশের দেয়ালে পাবেন না কোনো ব্যতিচার প্যাটার্ন।

বিষয়টা একটু আশ্চর্যের। ইলেকট্রন কি তাহলে আপনার মন পড়তে পারে। কিংবা বুঝতে পারে কোন ফুঁটোই আপনি যন্ত্র রেখেছেন?

এ প্রশ্নের উত্তর নেই। যেহেতু পরীক্ষা করে প্রমাণিত, তাই না মেনেও আপনার উপায় নেই। এ ঘটনায় আসলে তরঙ্গ ফাংশন সাই এ ভাঙন ধরে। তাই যেকোনো একটা ফুটোতে যন্ত্র লাগানোর পরে ইলেকট্রনের গতিপথ নির্দিষ্ট হয়ে যায়।

আপনি যদি চান ইলেকট্রনকে কণা হিসেবে দেখতে, তাহলে সে কণা হিসেবেই আপনার কাছে ধরা দেবে অদ্ভুত ঘটনা। বড়ই অদ্ভুত! কিন্তু অদ্ভুতুড়ের শেষ এখানেই নয়। আপনি এবার যন্ত্রটাকে দেয়ালের ওপারে যেকোনো একটি ছিদ্রের সামনে রাখুন। এখন ইলেকট্রনের সামনে যে দুটো ফুটো তার কোনোটাতেই যন্ত্র বসানো নেই। যন্ত্র আছে ওপারে একটা ফুটার সামনে। ইলেকট্রনের জন্য এখন দুটো পথই খোলা, তার সামনে কোনো যন্ত্র নেই কোনো বাধা নেই, সে চাইলেই দুই ছিদ্র দিয়েই যেতে পারে। তারপরে ওপারে গিয়ে না হয় ঠিক করবে ব্যতিচার প্যাটার্ন তৈরি করবে না। ওপারে যেহেতু একটা সেট দিয়ে সামনে যন্ত্র লাগানো আছে তাই একটু ঝামেলা হতে পারে।

কিন্তু ছিদ্র বেরোনোর আগে কোনো ঝামেলায় পড়ার কথা নয়। এখন আপনি সত্যি সত্যি একটা ইলেকট্রনকে ছেড়ে দিন দেয়ালের এপাশে। আপনি হয়তো ভাবছেন, ইলেকট্রনটি তরঙ্গ আকারে দুই ফুটো দিয়েই ওপারে ঢুকে পড়বে। কিন্তু না, এখানেও তরঙ্গ ফাংশন সাইয়ে ভাঙন ধরবে। আপনি দেখবেন দেয়ালের ওপারে যে ফুটোর সামনে যন্ত্র রেখেছেন সেটা দিয়েই ইলেকট্রন ঢুকে পড়েছে আর কণার মতো গিয়ে আঘাত হেনেছে ওপারের পর্দায়।

সূত্র: সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান

r1 ad
r1 ad