সিন্ধু নদীর পানি নিয়ে কেন এত দুশ্চিন্তায় পাকিস্তান?\n
কাশ্মিরকেন্দ্রিক সন্ত্রাসী হামলা ও তার জের ধরে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা নতুন কিছু নয়। এর আগেও একাধিকবার এমন ঘটনা ঘটেছে। কাশ্মিরকে নিয়ে দুই দেশের মধ্যেকার সংঘাতের শুরু সাতচল্লিশে দেশভাগের সময় থেকেই।
ইতিহাস বলছে, ১৯৪৬ সালে কাশ্মির রাজ্য গঠিত হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানি নৃগোষ্ঠী বাহিনীর হামলার পর কাশ্মিরের মহারাজা ভারতের সঙ্গে অধিগ্রহণ চুক্তি সই করেন। শুরু হয় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ। পরে ১৯৪৯ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে কাশ্মির ভাগ হয়।
১৯৬৫ সালে হয় দ্বিতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, যা শেষ হয় যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে। কাশ্মিরকে নিয়ে দুই দেশের এই বিবাদের মধ্যেই ষাটের দশকে কাশ্মিরি জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে জম্মু-কাশ্মির লিবারেশন ফ্রন্ট প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এই সংগঠনের লক্ষ্য ছিল ভারত ও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মিরকে পুনরায় একত্রিত করে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন।
কাশ্মির ঘিরে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কে স্থিতিশীলতা আনতে বড় ভূমিকা রাখে ১৯৭২ সালের শিমলা চুক্তি। এই চুক্তির মাধ্যমেই ভারত ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ রেখা (লাইন অব কন্ট্রোল, এলওসি) চূড়ান্ত করে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় এবং আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে একমত হয়।
আশির দশকে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থেকে সশস্ত্র প্রতিরোধ, গণবিক্ষোভ ও পাকিস্তান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে। হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। এর প্রভাব অব্যাহত থাকে নব্বইয়ের দশকেও। এর মধ্যে ১৯৯৯ সালে পাকিস্তান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী ভারতের অধীন কারগিলে অনুপ্রবেশ করলে দুই দেশ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, যা কারগিল যুদ্ধ নামে পরিচিত।
২০১৬ সালে উরি সেনা ঘাঁটিতে আত্মঘাতী হামলায় ১৮ ভারতীয় সেনা নিহত হন। ওই সময় ভারতের পালটা ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ আন্তর্জাতিক মনোযোগ কেড়ে নেয়। ২০১৯ সালের পুলওয়ামা আত্মঘাতী হামলায় অন্তত ৪০ জন সেনাসদস্য নিহত হন। এর জবাবে পাকিস্তানের বালাকোটে বিমান হামলা চালায় ভারত। এ বছরেরই আগস্টে ভারত সরকার জম্মু-কাশ্মির রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে, যা রাজ্যটিকে উল্লেখযোগ্য স্বায়ত্তশাসন দিয়েছিল। এর পর রাজ্যটিকে ভেঙে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে রূপান্তর করা হয়।
গত কয়েক বছরে জম্মু কাশ্মির এলাকায় বিপুল পরিমাণ সামরিক বাহিনী মোতায়েন করেছে ভারত সরকার। ওই এলাকাটি পর্যটনের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি সরকারের দাবি, সেখান থেকে ‘সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ নির্মূল’ করা হয়েছে।
এর মধ্যেই পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলা ভারতের জন্য বড় চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে। সেখানকার নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বরাবরের মতোই ভারত এবারও এ হামলার জন্য দায়ী করেছে পাকিস্তানকে। পাশাপাশি হামলার পরদিনই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পাঁচটি বড় ধরনের সিদ্ধান্তও ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সিন্ধু নদীর পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা।
এ হামলার পর ভারতের মিডিয়া ও রাজনৈতিক মহল থেকে দাবি উঠছে, পাকিস্তানকে কূটনৈতিকভাবে একঘরে করতে হবে। সরকারও আন্তর্জাতিক মহলে ঘটনাটি তুলে ধরেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, হামলাকারীরা যেখানেই থাকুক, তাদের খুঁজে বের করা হবে। হামলায় জড়িত ও তাদের দোসরদের অবশ্যই শাস্তি দেওয়া হবে।
ওদিকে পাকিস্তানও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, ভারত সিন্ধু নদীর পানি বন্ধ করে দিলে সেটিকে যুদ্ধের আহ্বান হিসেবেই তারা বিবেচনা করবে। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রীও বলেছেন, কাশ্মিরের উত্তেজনা তীব্রতা ছড়ালে তা দুই দেশকে ‘সর্বাত্মক যুদ্ধে’ জড়িয়ে ফেলতে পারে। ‘যেকোনো পরিস্থিতির জন্য’ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী প্রস্তুত বলেও জানান তিনি।
এর আগেও যেমন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মির ইস্যুতেই উত্তেজনা ছড়ালেও তা যুদ্ধ পর্যন্ত গড়ায়নি, এবারও তেমনটিই ঘটতে পারে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। তার অভিমত, ভারত নিজেদের গোয়েন্দা তথ্য বা নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যর্থতা ঢাকতেই হামলার দায় পাকিস্তানের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছে।
অধ্যাপক ইমতিয়াজ রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ভারতের যেকোনো ঘটনায় পাকিস্তানকে দায়ী করা গেলে তার একটা প্রভাব দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে রয়েছে। দেশের মানুষের কাছে এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া যায়। এ রকম ইস্যু এক ধরনের জাতীয়তাবাদী ঐক্য গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখে। এবারও একই ঘটনা ঘটেছে। তবে এ ধরনের চর্চার প্রধান সমস্যা হলো ঘটনার গোড়ায় পৌঁছানো যায় না। যারা মূল ঘটনায় দায়ী, তারা পার পেয়ে যায় বা ঘটনার আড়ালে চলে যায়।
এবারই দুপক্ষ থেকে সিন্ধু নদীর পানিবণ্টন চুক্তি ও শিমলা চুক্তি স্থগিতের মতো বড় সিদ্ধান্ত এসেছে, যা এসব চুক্তি সই হওয়ার পর থেকে কখনো হয়নি। দুই দেশের কূটনৈতিক মিশনে কর্মী কমানোর সিদ্ধান্ত এসেছে। এসেছে দুই দেশের জন্যই অন্য দেশের নাগরিকের ভিসা বাতিলের ঘোষণা। এমনকি দুই দেশের পদক্ষেপই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর্যন্ত গড়িয়েছে।
ফলের আগের ঘটনাগুলোতে না হলেও এবার দুই দেশের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেশি কি না— জানতে চাইলে অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, এমন সব সিদ্ধান্ত-ঘোষণা আগেও এসেছে। ভারত কিন্তু সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করেছে, বাতিল করেনি। তাদের কূটনৈতিক মিশনে কর্মী কমিয়ে ফেলতে বলেছে, কূটনৈতিক সম্পর্ক কিন্তু ছিন্ন করেনি। তাৎক্ষণিকভাবে বলা যায়, এত বড় একটি ঘটনায় ভারতের যে গোয়েন্দা ব্যর্থতা বা নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যর্থতা, সেগুলোকে ঢাকতে গেলে পাকিস্তানকে দায়ী করা ঢাল হিসেবে ভালো। কিন্তু পাকিস্তানকে আক্রমণ করতে গেলে সেটি ভারতের নাগরিকরাই মানবেন কি না, সেটিও দেখার বিষয়।
কাশ্মিরের উত্তেজনা থেকে অবশ্য ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে গড়াতেও পারে বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান সহযোগী অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী। এ ক্ষেত্রে তিনি ‘ডেমোক্রেটিক পিস থিওরি’কে প্রাসঙ্গিক মনে করছেন।
বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট ও ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত আমেরিকান রাজনৈতিক দার্শনিক থমাস পেইন প্রথম গণতন্ত্র ও শান্তির মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে তত্ত্ব দেন। এই তত্ত্বের মূল কথা, দুটি গণতান্ত্রিক দেশের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা একেবারেই কম। কারণ গণতান্ত্রিক দেশে নাগরিক মতামতের প্রাধান্য ও জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহিতা থাকায় রাষ্ট্রকে শান্তির ওপর জোর দিতে হয়। বিপরীতে একটি গণতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে অন্য একটি অগণতান্ত্রিক দেশের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা সবসময়ই রয়েছে। আর দুটি অগণতান্ত্রিক দেশ যেকোনো সময় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তেই পারে।
এই তত্ত্বের প্রসঙ্গ টেনে ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ভারতকে কাগজে-কলমে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ বলা হলেও আদতে নরেন্দ্র মোদি সরকারের অধীনে সেখানকার রাষ্ট্রক্ষমতা এখন হিন্দুত্ববাদের চর্চা করছে। গণতন্ত্রের খোলসে অগণতান্ত্রিকতা, কর্তৃত্বপরায়ণতার চর্চা করছে ভারত। অন্যদিকে পাকিস্তান রাষ্ট্রে শুরু থেকেই গণতন্ত্রের চর্চা নেই বললেই চলে। এ রকম দুটি দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে সেটি অস্বাভাবিক কিছু নয়। তারা তো এই তো ১৯৯৯ সালেও দুই দেশ যুদ্ধ করেছে।
তবে পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুই দেশের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ কারণে সরাসরি যুদ্ধে না জড়িয়েও ২০১৬ সালের উরি হামলার প্রতিক্রিয়ার ব্যবহৃত ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে’র মতো কৌশলগত আক্রমণের পথ বেছে নিতে পারে ভারত। সেক্ষেত্রে দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হলেও তা হয়তো বড় ধরনের যুদ্ধের দিকে ধাবিত হবে না।
ভারত ও পাকিস্তান সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা কাঠামোই হুমকির মুখে পড়বে। ভারত-পাকিস্তানকেও আঞ্চলিক কূটনৈতিক সম্পর্কগুলোর দিকেও তাকাতে হবে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের বাংলাদেশ হয়তো কোনো পক্ষেই ঝুঁকবে না। কিন্তু ভারতকে নেপাল, ভুটান ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সমর্থন চাইতে হবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক ঐক্য গড়ে তুলতে।
নানা ধরনের বৈরিতায় জড়িয়ে থাকায় এ ক্ষেত্রে চীনকে পাশে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই ভারতের। বরং চীনের সমর্থন চাইতে পারে পাকিস্তান। ইসলামি দেশগুলোর সমর্থন পেতেও নিঃসন্দেহে সক্রিয় থাকবে পাকিস্তান। সব মিলিয়ে দুই দেশের সংঘাতের রেশ ছড়িয়ে পড়বে বৈশ্বিক কূটনীতির পরিসরেও।
প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ঘাটতিও ভারতকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে বলে মনে করছেন ড. সাজ্জাদ। তিনি বলেন, আঞ্চলিক রাজনীতিতে এখন কোনো দেশই ভারতের সঙ্গে নেই। এমনকি নেপাল-ভুটানের মতো দেশগুলোর সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক ভালো নেই। বাংলাদেশ দীর্ঘ দিন ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। এখন জুলাই আন্দোলনের পর বাংলাদেশের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক হোঁচট খেয়েছে। সব মিলিয়ে আঞ্চলিক রাজনীতিকে ‘ইনসিকিউরিটি ফিলিং’ ভারতকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
আবার ভারতের জন্য যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতির সমীকরণকেই বাধা মনে করছেন ড. ইমতিয়াজ। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এই অধ্যাপক বলেন, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারতের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক রয়েছে, তারাও এই উত্তেজনার গতিমুখ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে। তারা কে কী পরামর্শ দেয়, সেটি গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সুসম্পর্ক আমরা দেখেছি। ট্রাম্প যখন রাশিয়া-ইউক্রেন বা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করবেন, তিনি নিশ্চয় ভারতকে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পরামর্শ দেবেন না।
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসও চলমান উত্তেজনায় উদ্বেগ জানিয়েছেন। ভারত-পাকিস্তান দুপক্ষেরই ‘সর্বোচ্চ সংযম’ দেখানো উচিত মন্তব্য করে জাতিসংঘ বলছে, দুই দেশই সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের চেষ্টা করতে হবে, যেন পরিস্থিতির আর অবনতি না হয়। আমরা বিশ্বাস করি, পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যেকোনো সমস্যার শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা যেতে পারে।